জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক: সিআইএ’র তথ্য

ডা: ওয়াজেদ এ খান, নিউইর্য়ক, ১৬ জানুয়ারি : একজন পাকিস্তানী  সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন’ বলে সম্প্রতি দালিলিক সত্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সংস্থাটির ওয়াশিংটনস্থ সদর দফতর সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ক গোপন দলিল অবমুক্ত করলে এ বিষয়ে গত ৯ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে গত ৮ ডিসেম্বর প্রেরিত নিবন্ধে মিজানুর রহমান খান সিআইএর গোপন দলিলের বরাত দিয়ে লিখেন- ‘সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলেও জিয়া ছিলেন ক্যারিশমেটিক নেতা । প্রায় ছয় বছরের নেতৃত্বে এক আশাবিহীন দরিদ্র ও বিশৃংখল অবস্থা থেকে তিনি বাংলাদেশকে সমস্যা মোকাবিলা করার উপযোগী করে তুলেছিলেন।’ ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রস্তুত সিআইএ’র বাংলাদেশ বিষয়ক হ্যান্ডবুকে দেশের প্রথম দশকের রাজনীতি মূল্যায়ন করে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। পর্যাপ্ত সামরিক নেতৃত্বের ঘাটতির সুযোগে সামরিক বাহিনী একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সিআইএর গোপন দলিলে জিয়াউর রহমানের প্রশংসার পাশাপাশি বলেছে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণকে তিনি আরো বিস্তৃত করেছিলেন।’এখানে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সফলতা, ব্যর্থতা আলোচনা সমালোচনায় না গিয়ে  শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে একটি মহল যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে জিয়ার ৭৭তম জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে তা নিয়ে আলোকপাত করা অত্যাবশক বলে মনে করছি।
ততকালীন মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ কানে শুনেছেন জিয়ার কন্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার বাণী। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয় বর্হিবিশ্বের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কেও জিয়াউর রহমানের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়ে। আর সেভাবেই সন্নিবেশিত হয় তাদের নথিতে। অবমুক্তকৃত সিআই এর গোপন দলিলে সেই সত্যটিই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ভারতের প্রেসিডেন্ট মোরারজী দেশাইও জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বিভিন্ন সময় উচ্চারিত হয়েছে এ প্রসঙ্গটি। জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ নিজ দায়িত্বে এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা ১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে। জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা  সিআইএর মত লন্ডনের সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান সহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।জিয়ার তেজোদীপ্ত কন্ঠের ঘোষণা শুনেছেন এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, সৈয়দ আলী আহসান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং, মেজর জেনারেল লছমন সিং, লে. জেনারেল মতিন, জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ অনেকেই তাদের নিজগৃহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানী জাহাজ থেকে অষ্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করে। এরপর বিবিসি’তে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রমাণ মিলে ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী  ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যেও। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলম্বিয়া  বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে বক্তৃতায় এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিব এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান, যার সুযোগ এখনো আছে। ‘ইন্ডিয়া সিকস’ (ওহফরধ ঝববশং) নামক বইতে ইন্দিরা গান্ধীর এ বক্তব্যটি সংকলিত হয়েছে।১৯৭৮ সালে ভারত সফরকালে দিল্লিতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় ভারতের ততকালীন প্রেসিডেন্ট নীলম সঞ্জীব রেড্ডি জিয়াকে বলেন, সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ তার “জোসনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসের (১৮২-১৮৩) পাতায় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন।এরকম অনেক উদাহরণ ও প্রমাণ রয়েছে দেশে বিদেশে বইপুস্তকে-দলিল দস্তাবেজে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উক্তিতে। একাত্তরে ২৬ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হন পাকবাহিনীর হাতে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো সুযোগ ও সময় কোনটাই ছিলো না। সেদিন শেখ মুজিবের কন্ঠের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কেউ শুনেননি। তাতে কিবা আসে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেখ মুজিবের ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে না পারার কারণে তার মর্যাদা বিন্দুমাত্র ম্লান হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
অথচ এমন একটি স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মিথ্যে প্রমাণিত করার যারপরনাই চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে । দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে কোর্ট-কাচারী, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি রাষ্ট্রীয় সংবিধান পাল্টিয়ে জিয়াউর রহমানকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টায় রত বর্তমান সরকার। বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস। প্রতিহিংসার করাত চালিয়ে জাতিকে চিড়ে ফেলার চেষ্টা কখনো শুভ হতে পারে না। ইতিহাসে যার যেখানে স্থান সেখানে অবশ্যই তাকে সমাসীন করতে হবে। কাউকে অবমূল্যায়ন, অবমাননা করে কিংবা একজনের জায়গায় অন্যকে প্রতিস্থাপিত করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। জিয়াউর রহমান এবং বাংলাদেশের ইতিহাস এক ও অভিন্ন। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে দেশ যখন ভয়াবহ ক্রান্তিকালে নিপতিত; হয়েছে তখনই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে লড়াকু অকুতোভয় সৈনিক জিয়া। আজকের আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি কালজয়ী দর্শন বাংলাদেশী  জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও উতপাদনের রাজনীতির প্রবর্তক শহীদ জিয়া। ছেঁড়া গেঞ্জী ও ভাঙ্গা স্যুটকেস নিয়ে অনেকে কটাক্ষ করলেও জিয়ার চরম শত্রুপক্ষ তার সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে আজও কোন  প্রশ্ন তুলতে পারেনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সকল ধর্ম-বর্ণ ও মতের মানুষকে সমন্বয় করে গোটা জাতিকে একই সূত্রে গ্রথিত করে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন জিয়া। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পরিবর্তে গণতন্ত্রকে করে তুলেন সহনশীল। শহীদ জিয়ার গৃহীত পররাষ্ট্র নীতি বাংলাদেশকে দ্রুত পরিচিত করে তুলে বর্হিবিশ্বে। বিদেশে জনশক্তি রফতানির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু জিয়ার শাসনামলেই । রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা যখন সমান তালে চলছিলো ঠিক তখনই দেশী বিদেশী চক্র জাতীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের সাহসী নেতা জিয়াকে হত্যা করে । থেমে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকা, অগ্রগতির ধারা । শুরু হয় বিভেদ ও অনৈক্যের রাজনীতি । অসুস্থ রাজনীতির বহমান এ ধারা দেশ ও জাতিকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সে আশংকাই আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিভেদ বিভ্রান্তি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে তাদের নিজ নিজ মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। ইতিহাসে নির্ধারিত স্থান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমান এবং জিয়াউর রহমানকে বিচ্যুত করার কোন সুযোগ নেই। শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও শহীদ জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক। এনিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করে জাতিকে কখনোই ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। সৌর জগতে চন্দ্র সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র যে যার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে। কারো সাথে কোন সংঘর্ষ হচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশের দু’নক্ষত্রকে নিয়ে কেন বিতর্ক এবং সাংঘর্ষিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অনন্য অসাধারণ ভূমিকা অন্য কোন নেতার উজ্জল্য যেমন ম্লান করে না কারো অবস্থানে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে দাঁড় করায় না । একটি স্বীকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে নুতন কিছু চাপিয়ে দেয়া যায় না । মানুষ যেমন ইতিহাসের ধারক ও বাহক ইতিহাসও তেমনি ব্যক্তি নির্মাণের নিখুত কারিগর। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত আজও যার কন্ঠের ঘোষণা ইথারে অনুরণিত হচ্ছে। যিনি আজও বাংলাদেশের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে আছেন আপন মহিমায়। আদালতের ফরমায়েশী রায় দিয়ে ইতিহাস পাল্টিয়ে কোনভাবেই তাকে খাটো করা যাবে না। আর এ খন্ডিত ইতিহাস, খন্ডিত মূল্যায়ন জাতি কখনোই গ্রহণ করবে না।

লেখক: নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *