মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা

amajuddinএ মা জ উ দ্দী ন আ হ ম দ : ক’দিন আগে সংবাদপত্রের পাতায় দেখলাম হাইকোর্টের এক বেঞ্চ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে জিয়াউর রহমানের ফাইলটি বিচারকদের নিকট হাজির করতে। খুব সম্ভব সম্মানীয় বিচারকগণ সেই ফাইল থেকে জানতে চান মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা এবং দিয়ে থাকলে কখন, কোন দিন, কোথা থেকে। হয়তো কয়েক দিনের মধ্যে সেই ফাইলটি বিচারকদের কাছে উপস্থাপিত হয়েও যাবে। হাইকোর্টের পক্ষ থেকে তারপর সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন কিনা। কেননা এ বিষয়ে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তার পরও কিছু প্রশ্ন থাকে, যে বিধি-বিধান ও আইনের বলে বিচারকগণ এই ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, তার ভিত্তি কী? স্বাধীনতা লাভের মতো ঐতিহাসিক অর্জনে কোনো বিচারালয় কি কোনো ভূমিকা রেখেছেন? স্বাধীনতার ঘোষণার মতো ঐতিহাসিক পদক্ষেপের কাহিনী কি কোনো রাষ্ট্রপতির ফাইলে থাকে? আর থেকে থাকলেও কোনো বিচারক কোন মানসিকতায় রাষ্ট্রপতির ফাইল ঘাঁটার মতো অবিমৃষ্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারেন? আমার বা তাদের মতো চাকরির জন্য কি জিয়াউর রহমানের bio-data রয়েছে সেই ফাইলে? দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই দেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছে এবং সংবিধানের প্রাপ্ত ক্ষমতা বলেই বিচারকদের এ ক্ষমতা। দেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা তুলনাহীন, বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের মতো শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার, তাঁর ফাইল পরীক্ষা করা আইনত সিদ্ধ হতে পারে; কিন্তু জাতীয় বিবেকের কিঞ্চিত্ অধিকারী হলে যে কেউ এমন পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতেন। ভাগ্য ভালো, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ফাইল নিয়ে এখনও টানাটানি শুরু হয়নি।
জিয়াউর রহমানের ফাইলে কী আছে আমি জানি না। এ সম্পর্কে কিছু জানারও কোনো আগ্রহ আমার নেই। তবে জিয়াউর রহমানের সহযোগী ও সহকর্মীরা কে কী বলেছেন, তা আমি জানি। জানি তাঁদেরই লিখিত বই-পুস্তক থেকে। মেজর রফিক-উল ইসলাম বীরউত্তম, মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) তার লেখা A Tale of Millions গ্রন্থের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দান করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কেন তিনি মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেজর রফিক-উল ইসলাম। একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা দিলে এই ‘আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র’ (‘Political Character of the Movement’) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থান সামরিক অভ্যুত্থান রূপে চিত্রিত হতে পারে, এই আশঙ্কায় দেশপ্রেমিক মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ঘোষণা দিলেন। তা শ্রুত হয় ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত (Rafiq-ul-Islam, A Tale of Millions, Dhaka. BBI, 1981)। মেজর রফিক বর্তমানে জাতীয় সংসদের একজন নির্বাচিত সদস্য। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রূপে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীরউত্তম, তাঁর গ্রন্থে—Bangladesh At War (Dhaka, Academic publishers, 1989) ৪৩-৪৫ পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন তা উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন : মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে (১৩-এর পৃষ্ঠার পর)
গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে, পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মোকাবিলার জন্য সবাইকে আহ্বান করেন। এই ঘোষণায় তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণায় বলেন : ‘বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সামরিক সর্বাধিনায়ক রূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ [“I Major Zia, Provisional Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the Independence of Bangladesh.”]। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিড়াল-কুকুরের মতো মরবো না, বরং বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তান রূপে (স্বাধীনতার জন্যে) প্রাণ দেব। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং সমগ্র পুলিশ বাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোহর, বরিশাল, খুলনায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘিরে ফেলেছে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।’ মেজর সফিউল্লাহর অভিব্যক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তার মতে, এই ঘোষণা দেশে এবং বিদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দীপ্ত করে। যারা ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধে রত ছিলেন এই ঘোষণা তাদের নৈতিক বল ও সাহসকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যরাও এই যুদ্ধে শামিল হন।
মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া, মেজর জেনারেল (অব.) তার লিখিত—মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস গ্রন্থের ৪৩-৪৪ পৃষ্ঠায় (ঢাকা, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৭২) লিখেছেন, ‘মেজর জিয়াকে ২৭ মার্চের সন্ধ্যায় দেখে উত্সাহ-উদ্দীপনায় ফেটে পড়ল বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা। ঘণ্টা দেড়েক চেষ্টার পর তিনি তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি তৈরি করে নিজেই সেটি ইংরেজি ও বাংলায় পাঠ করেন। মেজর জিয়া ওই ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাত্ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার পরের দিন আগের দেয়া বেতার ভাষণটির সংশোধন করে তিনি ঘোষণা দেন যে এই মুক্তিযুদ্ধ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে।
মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া একজন কৃতী মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মেজর জিয়ার সেই বক্তৃতা শুনে নিজের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করে বলেন, ‘মেজর জিয়ার ঐ উদ্দীপনাময় নেতৃত্ব আমাকে সংগ্রামের কাজে আরও উদ্বুদ্ধ করে তোলে। তখন থেকেই তাঁর নির্দেশে আমি কাজ করে যাই।’
কর্নেল অলি আহমদ, বীরবিক্রম, অক্সফোর্ড বুকস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের অনুবাদ গ্রন্থে-রাষ্ট্র বিপ্লব : সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা, অন্বেষা প্রকাশন, ২০০৮) আরো সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মেজর জিয়া ২৭ মার্চ ১৯৭১ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া ছিলেন আমাদের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি’ (মুখবন্ধ)। অলি আহমদ তখন ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন। সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার সময় তিনি মেজর জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন।
কর্নেল অলি আহমদ তার অভিসন্দর্ভ রচনার জন্যে সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন ৮ জন শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তার। তাদের সবাই বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে জিয়াউর রহমান প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা তারা শুনেছেন। সেক্টর নম্বর ৫-এর কমান্ডার তত্কালীন মেজর এবং পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী, বীরউত্তম বলেন, অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি (পৃষ্ঠা ১৬৬, ১৬৭, ১৭১)। ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার (১৫ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর) ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ খান লেখকের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন : ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে মেজর জিয়ার সদলবলে বিদ্রোহ এবং ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।’
এতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তাদের বক্তব্য তুলে ধরলাম এ জন্যে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তারাই ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ১০ এপ্রিলে স্বাধীনতার সনদ রচনা এবং ১৭ এপ্রিলে মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার গঠিত হলে রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নাম ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তখন থেকে সামরিক কর্মকর্তারাও বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে এবং তাদের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারাই কিন্তু দীর্ঘ তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখেন। তারা এ জাতির শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
শুধু বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তা কেন, বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের ভাবনাচিন্তাও ছিল এমনি। তাঁরাও একপর্যায়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও বাংলার দামাল ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এমনি একজন সুখান্ত সিং। মেজর জেনারেল হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর The Liberation of Bangladesh, Vol. 1 (Delhi : Lancer Publishers, 1980) গ্রন্থের ৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘ইতিমধ্যে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে একজন বাঙালি অফিসার মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।’ তিনি আরো লেখেন : ‘এই ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালি সেনা অফিসারগণ রাজনীতিক নেতাদের অসন্তুষ্ট করতে চাননি। অন্যদিকে ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেবার আবশ্যকতা ছিল।’ শুধু তিনি কেন, ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরে ভারতের রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে যে বক্তব্য প্রদান করেন, তাও উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রপতি রেড্ডি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আপনার দেশের ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণাকারী ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার সমুজ্জ্বল অবস্থান নিশ্চিত হয়ে গেছে।’ [মুহম্মদ শামসুল হক, (Bangladesh in International Politics, Dhaka, UPL, 1993, P-96] ।
সব মিলিয়ে যা বলতে চাই তা হচ্ছে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা হলেন এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। নিছক রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবমূল্যায়ন কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জিয়াউর রহমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সৈনিক। স্বাধীনতা ঘোষণার সময় যে পতাকা তাঁর সামনে ছিল, তা বাংলাদেশের পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নায়ক। ১৭ এপ্রিলে এ দায়িত্ব অর্পিত হয় বাংলাদেশের আরেক সূর্যসন্তান আতাউল গনি ওসমানীর ওপর। ১১ এপ্রিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন : ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের উপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে।’
যারা ২৬ মার্চে জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলেন তা তাদের বক্তব্য। আমার দীর্ঘকালীন গবেষণায় এই সত্য সুস্পষ্ট যে, তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের সন্ধ্যায় নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এর পরের দিনগুলোতে জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর নিজের কণ্ঠে ঘোষিত তাঁর কথা অন্য অনেকের মতো আমি নিজে শুনেছি। তাই বলবো, এই বিষয়ে বিতর্ক যত কম হয় ততই মঙ্গল এবং যার যা প্রাপ্য, তা তাকে দেয়াই সঙ্গত। ইতিহাস নিজস্ব গতিতে চলে। কারো নির্দেশে সে গতিপথ পরিবর্তিত হয় না।
দুই.
বহুবার বহু লেখায় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছি, যার যা প্রাপ্য তাকে তা দিতেই হবে। এক্ষেত্রে কেউ কোনো কার্পণ্য করলে ইতিহাস বাধ্য হয়ে তা সংশোধন করবে। সেই কার্পণ্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই। বাংলাদেশের জনারণ্য তেমন বড় না হলেও একেবারে ছোট নয়। এই অরণ্যে বটবৃক্ষের সংখ্যা হাজার হাজার না হলেও এই সংখ্যা তেমন ছোটও নয়। নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, খাজা সলিমুল্লাহ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, চিত্তরঞ্জন দাস, শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এক-একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক-একটা উজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁরা আমাদের জাতীয় সম্পদ। আমাদের জাতীয় নেতা। তাঁরা নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বটে, তাও কিন্তু জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যেই। তাঁদের জাতীয় সম্পদ রূপেই গ্রহণ করা উচিত। নেতৃত্বের উত্কর্ষে, জনসমর্থনের উচ্চতম মাত্রায়, জাতীয় এবং জনস্বার্থ ধারণের অভীপ্সায়, ব্যবস্থাপনার দক্ষতায় এবং ব্যক্তিমনকে সামষ্টিক পর্যায়ে আনয়নের সৌকর্যে এক-একজন দিকপাল। ইতিহাস তাঁদের স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাই ন্যায়বোধের নির্দেশনা হলো—যাদের যা প্রাপ্য, তা তাদের অকৃপণভাবে দেয়া উচিত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল এক অর্থে ছিল অত্যন্ত পবিত্র কাল। সব ভিন্নতা দূরে রেখে, এক সারিতে দাঁড়িয়ে, একই লক্ষ্যকে ধারণ করে, দেশি এবং বিদেশি দেশপ্রেমিক অকৃপণভাবে নিজেদের রক্ত ঝরিয়ে বাংলাদেশের মাটিকে উর্বর করে জাতীয় বিজয়ের চারাটি রোপণ করেছিলেন। বাংলাদেশের অন্যূন ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত মিশে গিয়েছিল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় সতের হাজার সৈনিকের রক্তের সঙ্গে। তাই তো স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার এক তীর্থ ক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফ আর জ্যাকব (ঔঋজ ঔধপড়ন)। তিনি তার ঝঁত্ত্বহফবত্ অঃ উঅঈঈঅ : ইরত্ঃয ড়ভ ধ ঘধঃরড়হ, (উযধশধ, টচখ, ১৯৯৭) বই এর ৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘চট্টগ্রামের আট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মেজর জিয়াউর রহমান রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বেতার ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন। সেই ঘোষণা অনেকেই শুনেছেন। যারা নিজ কানে শোনেননি তারাও মুখে মুখে চারদিকে প্রচার করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘মেজর জিয়া বাঙালি রেগুলার ও আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের সহায়তায় চট্টগ্রামে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন’ (পৃষ্ঠা ৩৫)। বাংলাদেশে ভারতের প্রথম ডেপুটি হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিত (JN Dixit), যিনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, তার লেখা গ্রন্থের Liberation And Beyond : Indo-Bangladesh Relations, (Dhaka, UPL, 1999) ৪২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান (যিনি ১৯৭৬-৭৭ সময়কালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) স্বল্পকালীন পরিসরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং সেই কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দান করেন। সেই ঘোষণায় তিনি বাংলার সকল সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিরোধের আহ্বান জানান।’ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার হওয়ার আগে রেকর্ড করা তাঁর ঘোষণার পূর্বেই জিয়াউর রহমানের ঘোষণা প্রচারিত হয় (“In fact, Ziaur Rahman’s broadcast came a little earlier than Mujib’s broadcast.”-Ibid)।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যখন শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচারণায় রত ছিলেন, তখন তিনি ওয়াশিংটনে জানতে পারেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বাংলাদেশের নন্দিত জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দিতে উদ্যত পাকিস্তানের নরপিশাচরা। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারেরও তাতে সায় ছিল। এমনি সময়ে ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক এবং সমাজের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে ৬ নভেম্বর তিনি বলেছিলেন : ‘স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিব গ্রেফতার হবার পরে, তার পূর্বে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোনো সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।’ [“The cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asked for independence even now.”]। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রদত্ত ভাষণটি দেখা যাবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের নিউজ লেটারে।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার যখন শুরু হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে তখন তাঁর এক কালের সহযোগী ও গুণমুগ্ধ সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহী স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন তাঁর পক্ষ সমর্থনের জন্য। তাঁর বক্তব্যেও তিনি পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারীদের সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শেখ মুজিব কোনো সময় পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে তিনি বরাবর চেয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়া হোক। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিজয় সূচিত হোক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে এ কে ব্রোহী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘তথ্য থাকলে প্রমাণ করুন’ (Prove if you have facts)।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যা বলেছিলেন, তাও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর।’ একই বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘এই প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর’ (স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড)। এই কণ্ঠস্বর কোনিট এবং কার তা বুঝতে কারো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
কোনো কোনো অর্বাচীন অবশ্য বলে থাকেন, মেজর জিয়া যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা তাঁর ঘোষণা নয়। তিনি শুধু সেই ঘোষণার পাঠক ছিলেন। এসব নিন্দুককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—তাহলে ঘোষণাটি কে লিখলেন? তার উত্তর এদের জানার কথা নয়। যারা জানেন তাদের একজন মেজর জেনারেল (অব.) এমএসএ ভূঁইয়া ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস (ঢাকা : আহমদ পাবলিশিং হাউস, পৃষ্ঠা ৪৩) বই-এ তারা উত্তরটি পেতে পারেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঘণ্টা দেড়েক চেষ্টার পর তিনি তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি তৈরি করে নিজেই সেটি ইংরেজিতে ও বাংলায় পাঠ করেন।’
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। জিয়াউর রহমান কোনো সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেননি। কোনো সময় প্রতিপক্ষও ভাবেননি। নিজে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, কিন্তু সপ্তাহ তিনেক পরে যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়, তখন সদলবলে নতুন সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয় ছিনিয়ে আনতে সংকল্পবদ্ধ হন। এমন মানুষ সম্পর্কে কোনো সমালোচনা চলে? যার যা প্রাপ্য, তা নিশ্চিত করাটাই বিবেকবান মানুষের কর্তব্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *