বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা চরমপন্থীদের কাজ : শেখ মুজিব

bhutto with mujib 1“আমাকে গ্রেফতার করুন। অন্যথায় চরমপন্থীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে” – পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এ অনুরোধ করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে ঢাকায় সামরিক শাসক টিক্কা খানের গণসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার লিখিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ পুস্তকে এ দাবী করেছেন। ২৩ শে মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনাকালে মুজিব ইয়াহিয়াকে এ অনুরোধ করেন। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় পাক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে, আর মুজিবের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ইয়াহিয়া খানের বাহিনী মুজিবকে তার বাসভবন থেকে আটক করে করাচি নিয়ে যায়। অন্যদিকে মুজিবের আশংকাকে সত্য প্রমান করে ২৬ মার্চ ঐ চরমপন্থীরাই পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষণা করে চট্টগ্রাম থেকে, যখন মুজিব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের পথে। কালুরঘাট রেডিও ষ্টেশন থেকে প্রচারিত চরমপন্থীদের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল, “I, Major Ziaur Rahman, Provisional Persident and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle, Bangladesh is independent. We have waged war for liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from occupation of Pakistan Army. Inshallah, victory is ours.” (সূত্র: বালাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র,৩য় খন্ড). সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বাংলাদেশী কূটনীতিক তার Understanding Bangladesh পুস্তকে স্বাধীনতা ঘোষণার ঘটনাটি সম্পর্কে বর্ণনা করেন এভাবে, “


(S. Mahmud Ali, 2010. Understanding Bangladesh. Columbia University Press. Page 59).

সমঝোতা না স্বাধীনতা
সত্তরের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ পূর্বপাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে পাকিস্তানের ক্ষমতা লাভের দাবীদার হন। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ী পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টোও ক্ষমতা দাবী করেন। সামরিক প্রশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় গণপরিষদের অধিবেশন ডাকেন, পরে তা স্থগিত করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এ টালবাহানায় বাংলার মুক্তিকামী জনতা ফুঁসে উঠে। শেখ মুজিব ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় পাক সরকারের প্রতি চরম হুঁশিয়ারী উচ্চারন করেন। ক্ষমতা হস্তান্তেরের প্রশ্নে আলোচনার জন্য ইয়াহিয়া ঢাকা এলেন এবং ১৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ অবধি মুজিবের সাথে দাফায় দফায় আলোচনা করলেন। অন্যদিকে,ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও সংগ্রামী জনতার গণআন্দোলন, স্বাধীনতার নানাবিধ প্রস্তুতি, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন সব মিলিয়ে পাকিস্তান বিভক্তির দিকে এগিয়ে যায়। মুজিবকে সামনে রেখে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মুজিবের মুখ থেকে ‘স্বাধীনতা’কথাটি বের করতে পারেনি সংগ্রামী ছাত্ররা। তিনি ইয়াহিয়ার আলোচনার ফাঁদে পা দিলেন। অন্যদিকে আলোচনার আড়ালে চলতে থাকে ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র জনতার উপর সামরিক আঘাতে আক্রান্ত জাতি সহসাই ঘুরে দাড়ায় – শুরু হয় প্রতিরোধ। প্রথমে চট্রগ্রাম সেনানিবাসে পরে কালুরঘাট রেডিও থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও যুদ্ধের ঘোষণা আসে। দেশ জড়িয়ে পড়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে। ভারত এ যুদ্ধে সরাসরি সামিল হয় ‍৩ ডিসেম্বরে, যার ১০ দিনের মধ্যেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়। অথচ, ২৫ মার্চ শেখ মুজিবের আটকের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত পাকিস্তান কাঠামোর আওতায় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ন পন্থায় ক্ষমতা প্রাপ্তিই ছিলো আওয়ামীগের একমাত্র লক্ষ্য। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি সম্পাদনের জন্য ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি এমএএম আহসানের কাছ থেকে শেখ মুজিবের প্রতিনিধি ডঃ কামালের নিকট একটি ফোন আসার কথা ছিল। কিন্তু আসে নি। ঐ কাঙ্খিত ফোনটি এলে হয়ত পাকিস্তানের ক্ষমতা পেতেন মুজিব, কিন্তু বাংলার মানুষ আজও পেত না ‘স্বাধীনতা।’ ইয়াহিয়া খান বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য লেলিয়ে দিলেন সেনা। আর তার প্রতিক্রিয়াজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শেষ অবধি পাকিস্তান ভেঙ্গে জন্ম নেয়- ‘বাংলাদেশ।’

ইয়াহিয়া-মুজিব সমঝোতা
ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে মার্চের ১৭ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত দফায় দফায় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব জানান, ফলপ্রসু না হলে তিনি আলোচনা করতেন না। এ সমঝোতা প্রসঙ্গে জানা যায়, “দুই পক্ষ অন্তবর্তী সরকার নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। বৈঠক শেষে শেখ মুজিব একজন সিনিয়র সামরিক অফিসারকে জানালেন যে, তিনি এবং ইয়াহিয়া এগারজন মন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীসহ ছয় জন আসবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে, এবং বাকী পাঁচজন আসবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে” (সুত্রঃ Richard Sisson & Leo E. Rose,1990. ‘War and Secession Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh’, University of California Press). ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া ও আওয়ামীলীগের প্রতিনিধিদের খুটিনাটি আলোচনা শেষে চারটি বিষয়ে ঐক্যমত হয়‍ঃ

ক) ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অনুসরনে প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
খ) কেন্দ্রে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন।
গ) প্রদেশসমুহের ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ট দলের হাতে হস্তান্তরিত করা হবে।
ঘ) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা প্রথমে আলাদাভাবে বৈঠকে বসবেন, পরে পরিষদের যুক্ত অধিবেশনে সংবিধান চুড়ান্ত করা হবে। (সূত্র: সাইদুর রহমান, ২০০৪। ‘১৯৭২-৭৫ কয়েকটি দলিল’ পৃষ্ঠা ৬৪)

২৪ মার্চের বৈঠকে ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি ও আওয়ামীলীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ডঃ কামাল হেসেন এবং ইয়াহিয়ার পক্ষে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, এম এম আহমদ, লেঃ জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। আলোচনাকালে আওয়ামীগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নাম “ফেডারেশন অব পাকিস্তান” প্রস্তাব করলে ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি বিচারপতি কর্নেলিয়াস “ইউনিয়ন অব পাকিস্তান” পাল্টা প্রস্তাব দেন। পরে ঠিক হয়, চুক্তি সাক্ষরকালে নাম চুড়ান্ত হবে। আলোচনা শেষে স্থির হ‍য়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি জেনারেল পীরজাদা পরের দিন অর্থাৎ ২৫ তারিখে কামাল হোসেনকে টেলিফোন করে দলিলে সাক্ষরের জন্য ডেকে নেবেন। কিন্তু মুজিবকে কিছু না জানিয়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন।

আমি একজন মুসলিমলীগার
পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে নির্বাচিত ন্যাপ নেতা খান ওয়ালী খান পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন ২২ মার্চ ১৯৭১। সাক্ষাৎকালে তিনি জানতে চান, তিনি (মুজিব) এখনও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন কি না। জবাবে মুজিব বলেছিলেন, ‌”খান সা’ব, আমি একজন মুসলিম লীগার” (মাহবুবুল আলম, বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, নয়ালোক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫)। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করতে পারেন না। ওই বৈঠকে ওয়ালী খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের ব্যাপারে সতর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেন, “তারা হয়ত আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে।” শেখ মুজিব হেসে বলেছিলেন “করতে চাইলে করুক, আমি তো স্যুটকেস রেডীই রেখেছি।”

২৭ মার্চের হরতাল
২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্হানে সৈন্যদের গুলিতে শত শত আন্দোলনকারী জনতা প্রাণ হারায়। এর প্রতিবাদে আওয়ামীলীগ ২৭ মার্চ সারা দেশের হরতালের ডাক দেয়। এটাই ছিলো ২৫ মার্চ ঘোষিত আওয়ামীলীগের সর্বশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচি। ২৫ মার্চ রাতে এ সংক্রান্তে একটি বিজ্ঞপ্তি সকল প্রেসে যায় এবং ইত্তেফাকসহ অন্যান্য পত্রিকায় ২৬ তারিখে ছাপা হয়। এ সকল আলোচনা, সমঝোতা, এমনকি ২৭ তারিখ হরতালের ঘোষণা সবকিছুই নির্দেশ করে, আওয়ামীলীগ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ক্ষমতালাভের পথে হাটছে- দেশ ভাগ বা স্বাধীনতা পেতে নয়। এ প্রসঙ্গে এন্থনী মাসক্যারেনহাস লিখেছেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১জন সংবাদবাহক স্থানীয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মাঝে ১টি প্রেসনোট বিলি করেন যেটিতে মুজিবের পক্ষ থেকে আবেদন ছিলো,”প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চুড়ান্ত হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের মতৈক্য হয়েছে এবং আমি আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষনা করবেন।” এ বিষয়ে মাসক্যারেনহাস মন্তব্য করেন, “আমার দুঃখ হয়, এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই” (সূত্র: এন্থনি মাসকারেনহাস, ১৯৭৩, ‘রেপ অব বাংলাদেশ’, অনুবাদ‍ঃ মযহারুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১১৩)

স্বাধীনতা ঘোষণায় মুজিবের অস্বীকৃতি
২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বত্রিশ নম্বরে এসে মুজিবকে সম্ভাব্য আক্রমনের কথা জানাচ্ছিল। একে একে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামাল হোসেন, পাকিস্তানী সাংবাদিক তারিক আলী, ক্যাপ্টেন রহমান, আঃ রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ দেখা করে মুজিবকে অনুরোধ করেও স্বেচ্ছায় কারাবরন রোধ করতে পারেন নি, বরং তিনি বাসভবন থেকে গ্রেফতার বরণের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। রাত নয়টায় ডঃ কামাল হোসেন দেখা করলে মুজিব জানতে চান, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি জেনারেল পীরজাদার কাঙ্খিত ফোনটি এসেছিলো কি না। কামালের নেতিবাচক জবাবে মুজিব হতাশ হয়ে পড়েন। এ সম্পর্কে ডঃ কামাল হোসেন লিখেছেন,”এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখনও শেখ মুজিব আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ঐ টেলিফোন পেয়েছি কিনা। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমি তা পাইনি। এ রাতেই পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙ্গালী জনগণের ওপর আক্রমন চালাল এবং গণহত্যা ও রক্তস্নান শুরু হল, যা এড়ানোই ছিল আলাপ-আলোচনা চালানো ও দর কষাকষির মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছানোর এখানে প্রধান লক্ষ্য” (সূত্রঃ ডঃ কামাল হোসেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল’, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭). ২৫ মার্চ রাত আটটার পরে দলীয় সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ একটি টেপরেকর্ডার এবং ছোট্ট একটি খসড়া ঘোষণা শেখ মুজিবকে এগিয়ে দিয়ে সেটা তাকে পড়তে বলেন। ওটি ছিলো স্বাধীনতার ঘোষণা এবং যুদ্ধের আহবান। কিন্তু মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তার ভয় ছিলো, এ কাজ করলে পাকিস্তানীরা তার বিরুদ্ধে এটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করবে। এখান থেকে দু’টি বিষয় পাওয়া যায়- ১. মুজিব স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ২. তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত হতে চান না। যুদ্ধকালে তাজউদ্দিন সাহেব তার বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসানকে এ ঘটনাটি বলেছিলেন। ঐ ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিনও পরবর্তীকালে এ বিষয়টি মঈদুল হাসানকে ‍নিশ্চিত করেছেন (‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ প্রথমা প্রকাশনী ২০১০), যা তার বর্ননায় পাওয়া যায়

pic5

স্বাধীনতার প্রচারপত্রের রহস্য

২৬ মার্চ পাকিস্তানী আক্রমনের মুখে শেখ মুজিবের নামে একটি প্রচারপত্র ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ে – তাতে পাকবাহিনীর আক্রমনের কথা উল্লেখ ছিল এবং আহবান ছিল লড়াইয়ের। এর সূত্র খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ২৫ তারিখ রাতে ৩২ ধানমন্ডি থেকে নিজের বাসায় ফেরেন তাজউদ্দিন, অতঃপর আমীরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে লালমাটিয়ায় আবদুল গফুরের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন, যার পাশেই ছিলো ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অফিস। এ প্রসঙ্গে মঈদুল হাসান বলেন, “স্বাধীনতার ঘোষণার ওই যে ছোট্ট খসড়াটি তাজউদ্দিন আহমদ তৈরি করেছেলেন ২৬ মার্চ, সেটির প্রায় একই রকমের ঘোষণা দেখি- একই সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য কাগজে প্রচারিত হতে, ভারতের কাগজেও হয়েছে। সুতরাং আমি ধরে নিতে পারি, সে সময় তাজউদ্দিন আহমদ যে খসড়া করেছিলেন, সেটা অন্য কাউকে তিনি হয়তো দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তখন তরুণ কর্মীর কোনো অভাব ছিল না। বিশেষ করে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব তখনই স্বাধীনতা ঘোষণা চাইছিল। এদের মাধ্যমে যদি এটা প্রচারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমি বিস্মিত হব না” (সূত্রঃ ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’, প্রথমা প্রকাশনী, ২০১০)। এর একটি কপি হয়ত উৎসাহী কেউ টেলিগ্রাম অফিসে পৌছে দিয়ে থাকতে পারে, যা সেখান থেকে বিভিন্ন স্থানে টেলিগ্রামে যেতে পারে। তাহলে এটাই হচ্ছে, শেখ মুজিবের নামে তথাকথিত বার্তাটির গূঢ় রহস্য- যা মুজিবের অগোচরেই নিজ দায়িত্বে তাজউদ্দিন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন?

ওয়াকিটকির মিথ
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আওয়ামীলীগ থেকে দাবী করা হয়, মুজিব চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন।এ দাবী খন্ডন করেছেন যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান,”১৯৭১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের নেতারা স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে ভারত সরকারকে খুব বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করেন। তখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ভারত সরকার গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করে। তারা বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রমাণ, কোনো দলিল, কোনো জীবিত সাক্ষ্য আপনাদের আছে কি? ভারত সরকার বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও অন্য প্রধান নেতাদের জিজ্ঞাসা করেছে যে, কাউকে কিছু বলে গেছেন কিনা শেখ মুজিবুর রহমান। এর মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীও ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছেন, কাউকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে যাননি। জহুর আহমদ চৌধুরী নিজে তাজউদ্দিনকে বলেছেন তাকে কিছু বলা হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে ১৯৭২ সাল থেকে যে দাবিগুলো করা হয়, সেটা হচ্ছে ইপিআর সিগন্যালসের মাধ্যমে তিনি খবর পাঠিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। অর্থাৎ, যেভাবেই হোক, জহুর আহমদ চৌধুরীকে সেটা পাঠিয়েছিলেন। অথচ রাত সাড়ে ১২টায় টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব যদি একটা ফোন করে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ভিড় করা যে কোনো বিদেশি সাংবাদিককে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা জানাতেন, তাহলে সারা পৃথিবীতে সঙ্গে সঙ্গে তা রাষ্ট্র হয়ে যেত।….পরে ঘটনার প্রায় এক বছর পর বলা হয়, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শেখ সাহেব নিজে ইপিআরের সিগন্যালসের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় খবর পাঠান। আমি যতটুক জানি, সামরিক বাহিনীর সিগন্যালস সব সময় অত্যন্ত বিশ্বাসী লোকদের দ্বারা গঠন করা হয়। সিগন্যালসই কোনো বাহিনীর আত্মরক্ষার ও আক্রমণের মূল যোগাযোগ মাধ্যম। আর ইপিআর ছিল মিশ্র বাহিনী। এই বাহিনীতে অনেক অবাঙালিও ছিল। সেখানে তাদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যালস থাকতে পারে না। কাজেই ইপিআর সিগন্যালসের মাধ্যমে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন – এটা বোধহয় অবাস্তব কথা।” বাস্তব হলো, ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরুর ২ দিন আগে ২৩ মার্চ বেলুচ রেজিমেন্ট পিলখানার দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং ২৫ মার্চ দুপুরে ইপিআরের বাঙ্গালী সদস্যদের নিরস্ত্র করা হয়, এটা আটকের আগেই শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক নেতা আঃ রাজ্জাক। কাজেই ইপিআর ওয়ারলেস যোগে বার্তা পাঠানো সম্পূর্ন অসম্ভব। আর কথিত ইপিআর শওকত আলীর ওয়াকিটকি থেকে চট্টগ্রামে কেনো মেসেজ পাঠানো পুরোপুরি অবাস্তব ঘটনা। কেননা, ঢাকা থেকে চিটাগাংয়ের দুরত্ব ২১২ কি.মি.ওয়াকিটকির নেটওয়ার্কের বাহিরে। প্রযুক্তির এ চরম বিকাশের যুগে ঐরূপ কোনো ওয়াকিটকি অদ্যাবধি আবিস্কার হয়নি। তাছাড়া ইপিআরের ওয়ারলেস মারফত কোনো সংবাদ চট্টগ্রাম পাঠালে সেটি প্রথমেই জানার কথা চট্টগ্রাম ইপিআরের অধিনায়ক মেজর (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) রফিকের। কেননা, তিনি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের লোক। কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিক এরকম কোনো বার্তার কথা কখনই স্বীকার করেন নি। বরং তার দাবী, ঐদিন তারা অনেক চেষ্টা করেও ঢাকার সাথে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন নি। স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে শেখ মুজিবের দাবীর সমর্থনে এগিয়ে আসেন আওয়ামী গবেষক ডঃ মযহারুল ইসলাম। ১৯৯৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিব’ গ্রন্থে ডঃ মযহার দাবী করেন, ২৫ তারিখ রাত ১০ টার দিকে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে তাজউদ্দিন ও ওসমানীর সাথে তিনিও ইংরেজীতে Declaration of Independence মুসাবিদা করেন। অথচ এ বইয়ের ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে ওই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। তাছাড়া ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দিন ৩২ নম্বর থেকে বেরিয়ে যান রাত ৯টার আগেই। সেক্ষেত্রে রাত দশটায় তাজউদ্দিনের উপস্থিতিতে খসড়া তৈরীর দাবী- বানোয়াট বলেই প্রতীয়মান হয়। তাজউদ্দিন নিজে মঈদুল হাসানকে বলেছেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে মুজিব রাজী হননি। ‍মুজিব তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। একইরূপ কথা জোহরা তাজউদ্দিনও সাক্ষাৎকারে বলেছেন। এর মাধ্যমেই ডঃ মাযহারের খসড়া গল্পটির অসাড়তা প্রমানিত হয়।
স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্টেট
২৫ তারিখের ক্রাক ডাউনের খবর শেখ মুজিব আগাম জেনে যান বিভিন্ন মাধ্যমে। মুজিব তার দলীয় নেতাকমী ও পরিবারের লোকদের আত্মগোপনে পাঠিয়ে নিজে সস্ত্রীক রয়ে গেলেন বাসভবনে এবং মধ্যরাতে তার গুছিয়ে রাখা হোল্ড-অলটি নিয়ে পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেন (বেগম মুজিবের সাক্ষাৎকার ১৯৭৩)। এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট সাংবাদিক জ্যোতি সেন গুপ্ত লিখেছেন, ২৪ তারিখে গোয়েন্দা সূত্র পাক বাহিনীর আক্রমনের আগাম সংবাদ জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগকে। কর্নেল ওসমানী ঐ দিনই মুজিবের সাথে দেখা করে তাকে অবহিত করেন। শেষ রাত পর্যন্ত নেতারা করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, তারা আত্মগোপন করবেন এবং পালিয়ে ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাজউদ্দিন এসে দেখেন মুজিব তার বিছানাপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে আছেন। মুজিব তাকে বললেন, তিনি থেকে যাবেন- গ্রেপ্তার বরণ করবেন (সূত্রঃ মাসুদুল হক, দৈনিক ইনকিলাব ২৬ মার্চ ২০০৫)। আটকের পর থেকে পরবর্তী তিন দিন মুজিবের অবস্থান কার্যত ছিলো অজ্ঞাত। অনেকেরই ধারনা ছিলো, মুজিব আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে উল্লেখ করে, “Yahya Khan left Daca abruptly on 25 March 1971 and Tikka Khan let loose his reign of terror the same night. The next day, while the whereabouts of Mujib remained unknown, Major Ziaur Rahman announced the formation of the Provisional Government of Bangladesh over Radio Chittagong” অর্থাৎ মুজিবের নিখোঁজ অবস্থায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার কাজটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। অনেকে আজ প্রশ্ন তুলেছেন- মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষনার কতৃত্ব নিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা সত্বেও গণমানুষের দাবী- ‘স্বাধীনতা’, যা একজন সৈনিকের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে- এটাই বাস্তবতা। সময়ের দাবী কোনো পার্লামেন্টের পাশ করা আইন বা ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করে না। পাকবাহিনীর অন্যায় ও অমানবিক আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য জনতা ঘুরে দাঁড়ায় এবং সাড়ে সাত কোটি জনতার কাঙ্খিত স্বাধীনতা যুদ্ধ করে আদায়ের লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিলো একটি ডাকের। আর সে ডাকই আসে চট্টগ্রাম থেকে। পক্ষান্তরে, আওয়ামীলীগের যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানা যায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান তরফদারের বর্ণনায়,”ফেব্রুয়ারী বা সম্ভবতঃ তার আগে থেকেই যে সমর প্রস্তুতি শুরু, তার অবশিষ্ট আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ধুম্রজাল বিস্তার করা হয়। এই আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যুগপৎ সন্দিহান ও আশাবাদী থাকায় আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের পক্ষে আসন্ন সামরিক হামলার বিরুদ্ধে যথোপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবতঃ একই কারণে ২৫/২৬ মার্চের মধ্যরাতে টিক্কার সমর অভিযান শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। শেষ মুহুর্তে আওয়ামীলীগ নেতা ও কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েও সহকর্মীদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব রয়ে গেলেন নিজ বাসভবনে। সেখান থেকে গ্রেফতার হলেন হত্যাযজ্ঞের প্রহরে” (সূত্রঃ মুলধারা ৭১)।

pic1

ইন্দিরা গান্ধির জবানীতে স্বাধীনতার ঘোষণা
যুদ্ধ শুরুর পরে তাজউদ্দিন আহমদ পালিয়ে ভারতে গিয়ে ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। এ সময় তাজউদ্দিন চিন্তিত ছিলেন, তার অবস্থান কি হবে এবং দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কি জবাব দিবেন। তার ভাবনা সম্পর্কে বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান জানিয়েছেন এভাবে, “তাজউদ্দিনের মনে কোন সন্দেহই ছিল না যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত তথা কোন বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। কাজেই, সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যদি সরকার গঠন করে থাকেন, তবে সেই সরকারের নেতৃস্হানীয় সদস্য হিসাবে তাজউদ্দিনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আসা এবং সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত ও সহজসাধ্য হবে বলে তাজউদ্দিন মনে করেন। অন্ততপক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবেই গণ্য হবে বলে তাঁর ধারণা জন্মায়।” অর্থাৎ তাজউদ্দিন পরিস্কার করেই জানেন, আটকের আগে মুজিব কেনো নির্দেশনা দিয়ে যান নি, তদুপরি ভারতের সাহায্য সমর্থন লাভের প্রয়োজনে স্বাধীনতার কথা এবং একটি সরকার গঠনের কথা তিনি জানাবেন। তাজউদ্দিনের এ বানানো গল্প যে ভারত সরকার বিশ্বাস করেনি, তা পরিস্কার হয় ইন্দিরা গান্ধীর ব্ক্তব্যে। মুজিবের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন রাজধানী সফরকালে ৬ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, “There is no other crime which these people have committed because the cry for Independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asked for Independence, even now But after he was arrested, after there was this tremendous massacre, it was only perhaps understandable that the rest of the people said, Well, after this how can we live together? We have to separate” (Ref: Bangladesh Documents Vol-II, Page-275, Ministry of External Affairs, Government of India-1972) অর্থাৎ তার জানামতে, শেখ মুজিব আটকের আগে বা ঐ সময় অবধি নিজে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি এমনকি স্বাধীনতা চান নি।

৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণা নয়
কেউ কেউ দাবী করে থাকেন, ৭ মার্চের ভাষণেই শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা ঠিক ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি বলেছেন, “এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরে ডেভিড ফ্রষ্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুজিব এ দাবীকে নাকচ করে বলেছেন, ৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি। ঐ ভাষণের শেষে তিনি বলেছিলেন, জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান। “জয় পাকিস্তান” বলে তিনি আলোচনার পথ খোলা রেখেছিলেন। সে আলোচনাই চলে ইয়াহিয়ার সাথে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। এমনকি, সকলের অনুরোধ সত্ত্বেও আলোচনার দুয়ার ও সমঝোতার পথ খোলা রাখার জন্যেই তিনি সেই বিভীষিকাময় রাতে নিজের বাসভবন ছেড়ে কোথাও যাননি। ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে আটক হবার পূর্বে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছেন, এমন প্রচারণার পক্ষে কোনো চাক্ষুষ বা প্রত্যক্ষ কেনো প্রমান বা সাক্ষ্য নেই। আটক হওয়া অবধি মুজিবের সাথে ছিলেন তার পত্নী ফজিলাতুন্নেসা। ১৯৭৩ সালে বেগম মুজিব এক সাক্ষাৎকারে সে দিনের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেন, “…রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে তারা (পাক সেনারা) গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপরে এলো।…তারপর মাথাটা নিচু রেখে নেমে গেলেন তিনি নিচের তলায়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আবার উঠে এলেন উপরে। মেঝো ছেলে জামাল এগিয়ে দিল তার হাতঘড়ি ও মানিব্যাগ। পাইপ আর তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সাথে” (দৈনিক বাংলা, ২৬ মার্চ, ১৯৭২)। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কোথাও বেগম মুজিব একটিবারও বলেননি যে, যাওয়ার আগে কোনো এক ফাঁকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকি আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ যুদ্ধ চলাকালে বা পরবর্তীকালে কখনই জানতেন না যে, শেখ মুজিব নিজে কখনো বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।

তাজউদ্দীনের ভাষ্য
১৯৭২ সালের ৮ই এপ্রিল আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। ঐ অধিবেশনে সাধারন সম্পাদকের রিপোর্টে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তাজউদ্দিন বলেন,”আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সংগ্রামেরত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা রোধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন” (সূত্রঃ দৈনিক বাংলা, ৯ এপ্রিল ১৯৭২)। এর ঠিক এক বছর আগে ১১ ই এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসী সরকার গঠনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কিভাবে চলছে সে সম্পর্কে স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত এক ভাষণে তাজউদ্দিন আহমদ জাতিকে অবহিত করেন, “The brilliant success of our fighting forces and the daily additions to their strength in manpower and captured weapons has enabled the Government of the People’s Republic of Bangla Desh, first announced through major Zia Rahman, to set up a full-fledged operational base from which it is administering the liberated areas.” (Ref: Bangladesh Document vol-I, Indian Government, page 284). তাজউদ্দিনের কোনো বক্তব্যেই শেখ মুজিব কতৃক স্বাধীনতা ঘোষণার কেনো বর্ণনা নাই। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সেখান থেকে সরকার ও পুর্নাঙ্গ একটি অপারেশনাল বেস পরিচালিত হবার কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করেছেন।

১৯৭২ সালে পাকিস্তানী নাগরিক হয়েও মুজিব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট
স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব ফিরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী। যুদ্ধ চলাকালে তিনি বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের ফ্রন্টইয়ার প্রদেশের মিয়াওয়ালি জেলে। একই কারাগারে বন্দী ছিলেন ডঃ কামাল হোসেন। কারাগারে প্রায়শই তাদের দেখা সাক্ষাৎ ঘটতো। ডঃ কামাল হোসেন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন,দেশে ফেরার জন্য মুজিব ও কামাল হেসেন পাকিস্তানী পাসপোর্ট তৈরী করিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে (সূত্রঃ  সাপ্তাহিক, ২৮ অক্টোবর ২০১০)। ওই পাসপোর্ট নিয়েই পাকিস্তানী নাগরিক হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশে আসেন ১০ জানুয়ারী ১৯৭২। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে-স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও মুজিব পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসলেন কোন্ বিবেচনায়? বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করা অসম্ভব হলে নিদেনপক্ষে জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাওয়া অসম্ভব ছিলো না। পাকিস্তানী বিমান ভারতের আকাশ পার হতে পারবে না, এমন খবর জেনে মুজিব যেখানে জাতিসংঘের বিমানে আসার কথা চিন্তা করতে পারেন, সেখানে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ব্যতিরেকে ভিন্ন ব্যবস্থায় ঢাকা আসা বিবেচনা করাই মুজিবের মত নেতার পক্ষে সঙ্গত ছিলো। আটকের আগে যদি শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েই থাকেন, তাহলে একটি স্বাধীন দেশের শীর্ষ নেতা হয়ে তিনি কি শত্রুরাষ্ট্রের পাসপোর্ট নিতে পারেন? এখানেই বড় বিস্ময়! বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানার পরে মুক্ত হয়ে তিনি প্রথমেই ঢাকায় কথা বলবেন- দলীয় সাধারন সম্পাদকের সাথে, তারপরে করণীয় ঠিক করবেন। তা না করে তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারী ঢাকায় এলেন। এসেই তিনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তখন তিনি কি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ছেড়েছিলেন? নাকি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেছিলেন? করে থাকলে, কবে? প্রশ্ন উঠে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে কি মুজিবের কাছে পাকিস্তানের পাসপোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ন ছিলো? এ প্রশ্নের জবাব মেলে এ কে ব্রোহীর কাছে, যিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে বিচারকালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শেখ মুজিবের আইনজীবি। ব্রোহী তার জীবন সায়াহ্নে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় লন্ডনের ইমপ্যাক্ট ইন্টারন্যশনাল পত্রিকার সম্পাদক মি. ফারুককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে দু’টি সত্য (facts) প্রকাশ করেছেন। তা হলো – যুদ্ধ চলাকালে ১. মুজিব অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন এবং কখনই পাকিস্তান ভাঙ্গার মত কোনো কাজ করেন নি, ২. পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রেডিও টিভিতে নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য দিতে ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুজিব। (সূত্র:Impact International, 25th September, 1987, Page.19).

পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন
একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ যখন চলমান, অন্যদিকে তখনও পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের প্রস্তাব নিয়ে আওয়ামীলীগের মধ্যে কাজ চলতে থাকে। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ পুস্তকে লিখেছেন, “যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত বাংলা জাতীয় লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এম আনোয়ারের উদ্যোগে আগরতলা এসেম্বলি মেম্বার রেষ্ট হাউসে আমার ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মালেক উকিলের মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর এক দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেন যে,শেখ মুজিবর রহমান গ্রেফতারের পূর্বমুহূর্ত অবধি কোন নির্দেশ দান করেন নাই। এইদিকে মুজিব-ইয়াহিয়ার মার্চ আলোচনার সূত্র ধরিয়া কনফেডারেশন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সমঝোতার আলোচনা চলিতেছে। জনাব মালেক উকিল আমাকে ইহাও জানান যে, তিনি এই আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে আশাবাদী। প্রসংগত ইহাও উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে আমি সর্বজনাব আবদুল মালেক উকিল, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল হান্নান চৌধুরী, আলী আজম, খালেদ মোহাম্মদ আলী, লুৎফুল হাই সাচ্চু প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সহিত বিভিন্ন সময়ে আলোচনাকালে নেতা শেখ মুজিবর রহমান ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোন নির্দেশ দিয়াছিলেন কিনা, জানিতে চাহিয়াছিলাম। তাহারা সবাই স্পষ্ট ভাষায় ও নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলেন যে,২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর আকস্মিক অতর্কিত হামলার ফলে কোন নির্দেশ দান কিংবা পরামর্শ দান নেতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। অথচ স্বাধীনতা উত্তরকালে বানোয়াটভাবে বলা হয় যে, তিনি পূর্বাহ্নেই নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন” (পৃষ্ঠা ৪২৪- ২৫)। এ থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামীলীগের সাথে পাক সরকারের যে একটা যোগাযোগ ছিলো। তাছাড়া এরূপ যোগসূত্র স্থাপনে বিদেশী কূটণীতিকও ছিলেন তৎপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী ক্রিস পারভেন মার্কিন সিনেট সাব কমিটির শুনানীতে জানিয়েছিলেন, ইয়াহিয়ার নিকট থেকে কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবের পরিবারের ভরন পোষণের জন্য তার স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে ১৫০০ পাকিস্তানী রূপী মাসিক ভাতার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যখন প্রতি ভরি সোনার দাম ছিলো ১৪০ রূপী (সূত্রঃ অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫)।

মুজিব স্বীকৃত স্বাধীনতাযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ন দলিল
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে পশ্চিম বাংলার (ভারত) আনন্দ পাবলিসার্স প্রকটি পুস্তক প্রকাশ করে যার নাম ‘বাংলা নামের দেশ’। এ গ্রন্থ সম্পর্কে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ ১৯৭২ তারিখে নিজ স্বাক্ষরিত এক বাণীতে বলেন, “বাংলা নামের দেশ গ্রন্থে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, সংগ্রামের আগের ও পরের ইতিহাস, ধারাবাহিক রচনা, আলোকচিত্রমালায় চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। বইটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ন দলিল।” অর্থাৎ শেখ মুজিব নিজেই সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন- এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। এ পুস্তকের বাণীতে নিজ স্বাক্ষরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন,”১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ্চ আমি ঘোষণা করেছিলাম ‘এই সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বহু নির্যাতন, বহু দুঃখভোগের পর আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। সেই সংগ্রামের কাহিনী ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। পাকিস্তানী সমরনায়কদের নরমৃগয়ার শিকার হয়েছে ৩০ লক্ষ লোক, এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। জঙ্গীচক্র আঘাতের পর আঘাত হেনেছে, কিন্তু আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনোবল তাতে ভেঙ্গে পড়েনি, আমরা স্বাধীনতা, আদায় করে নিয়েছি।” এখানেও দেখা যাচ্ছে,শেখ মুজিব নিজেই ২৬ মার্চের তথাকথিত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে নীরব রইলেন। তার মানে হতে পারে দুটোঃ হয় স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি শেখ মুজিবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, অথবা তিনি ঘোষণা দেন নি বিধায় এখানে উল্লেখ করেন নি। মুজিব স্বীকৃত স্বাধীনতা যুদ্ধেরে এই গুরুত্বপূর্ন দলিল “বাংলা নামের দেশ” পুস্তকের ৮১ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বলা হয়,”মুজিব গ্রেফতার। সর্বত্র সঙ্ঘশক্তি প্রায় তছনচ। এই শূন্য অবস্থাকে ভরাট করে তোলার জন্যে মেজর জিয়া রবিবার ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম রেডিও থেকে অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করলেন। তার প্রধান তিনি নিজেই। মনোবল বজায় রাখতে সব জেনেও বললেন, মুজিবের নির্দেশেই এই সরকার, তিনি যেমন বলছেন তেমন কাজ হচ্ছে” (বাংলা নামের দেশ। এপ্রিল ১৯৭২। আনন্দ পাবলিশার্স, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত)। উল্লেখ্য, এ বইতে শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী উভয়েই বাণী দিয়েছিলেন।

10276564_10154139949585556_1810958465_n

স্বাধীনতার সরকারী ঘোষণাপত্র

৪ নভেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। এ সংবিধানের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগন স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে ২৬ মার্চ ১৯৭১। বর্তমানে আওয়ামীলীগের তরফ থেকে দাবী করা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা’য় পরিস্কার হয়ে গেছে স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি, এবং বর্তমান সরকার ঐ ঘোষণাপত্রটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত করে দেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণাপত্রটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ গণপরিষদ সদস্যদের পক্ষ থেকে (পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য নির্বাচিত) একটি “স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা” প্রচার করা হয়, যা ১০ এপ্রিল থেকে কার্যকারিতা লাভ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ঐ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান এ ঘটনাটির ব্যাখা করেছেন এভাবে, ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার’ প্রধান মূল প্রয়োজন দেখা দেয় নবগঠিত সরকারের আইনগত ভিত্তি বৈধকরণের জন্যই” (মূলধারাঃ৭১)। মঈদুল হাসানের বক্তব্য থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, অস্থায়ী সরকারের অস্তিত্ব ও তার কার্যক্রমের আইনগত ভিত্তি বৈধকরনের জন্যই ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা’টি তৈরী করা হয়, যেখানে ভূতাপেক্ষভাবে ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর দেখানো হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই সকল প্রশ্নের জবাব মেলে – শেখ মুজিব কতৃক স্বাধীনতার ঘোষণা বাস্তবে ঘটনা না ঘটলেও, ধারনাগতভাবে এটি ২৬ মার্চ থেকে কাগজে কলমে দেখানো হয়, অন্যথায় প্রবাসী সরকারের অস্তিত্ব থাকে না।

কনফেডারেশনের অপমৃত্যু
১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনাকালে মুজিবের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন ড‍ঃ কামাল হোসেন। আগেই বলা হয়েছে, তিনিও শেখ মুজিবের সাথে পাকিস্তানের একই কারাগারে বন্দী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন,পাকিস্তানের মিয়াওয়ালী জেলে বসেই ১৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের সংবাদ পেয়েছিলেন (সাপ্তাহিক ২৮ অক্টোবর ২০১০)। এরপরে শেখ মুজিব ও ডঃ কামাল হেসেন কার্যতঃ প্রায় মুক্ত ছিলেন। ঐ সময় ভুট্টোর সাথে মুজিবের গুরুত্বপূর্ন বৈঠক হয়, যাতে ভুট্টো পাকিস্তানের দুই খন্ডকে কনফেডারেশন হিসাবে একত্র থাকার প্রস্তাব দিলে মুজিব তাকে আশ্বস্ত করে আসেন। ভুট্টো-মুজিব এ আলোচনায় মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে Stanley Wolpert তাঁর Zulfi-Bhutto of Pakistan বইটিতে লিখেছেন, “..I told you it will be confederation. This is also between you and me… You leave it to me…Absolutely leave it to me. Trust me… My idea was we will live together and we will rule this country. You know the occupation (Indian) army is there. “(P.175)। অনুরূপ আরেকটি সংবাদ পাওয়া যায়, পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পথে মুজিব লন্ডনে “দি টাইমস” এর প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসক্যারেনহাসকে একটি সুখবর দিয়েছিলেন। আর তা হলো, “Going to keep some link with Pakistan” (Anthony Mascarenhas, Bangladesh: A legacy of Blood, Chapter 5)। দু’দিন পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরন করলেন মুজিব। টারমাক থেকে তাজউদ্দিন ও খন্দকার মোশতাকের ঘাড়ে দু’হাত দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় মুজিব তাজউদ্দিন আহমদকে তিরস্কার করেছিলেন,”তাজুদ্দীন, শেষ পর্যন্ত তোমরা পাকিস্তান ভাইঙ্গাই ফেললা?” এ কথাটি শুনেছিলেন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের রচয়িতা প্রফেসর আফতাব আহমদ (সুত্রঃ তাজাম্মুল হোসেনের ওয়েবসাইট)। কিন্তু দেশে ফিরে মুজিব যখন দেখলেন, পাকিস্তান পুরোপরি ভাগ হয়ে গেছে এবং আর কোনভাবেই কনফেডারেশন সম্ভব নয়, এ বাস্তবতায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় ভুট্টোর উদ্দেশ্যে মুজিব বললেন, “আমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক সম্ভব নয়। আপনারা সুখে থাকুন।” এর অর্থ দাড়ায়, ১৯৭২ সালেও মুজিব তার মূল ভাবনা পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন নিয়ে বিভোর ছিলেন, কিন্তু বাস্তবতার কাছে তাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে। আর এভাবে মুজিব-ভুট্টোর সর্বশেষ সমঝোতা “পাকিস্তান কনফেডারেশনে”র অপমৃত্যু ঘটে।

( মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আলোকে একটি পর্যালোচনা )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *