ইতিহাসের কাঠগড়ায় শেখ মুজিব – পর্ব ১/৪

১৯৭১ সালের যুদ্ধ আওয়ামীলীগের কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’; ভারত পালন করে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’; আর জাতীয়তাবাদী ঘরানার কাছে এটি ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’। প্রত্যেকটি টার্মের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী মুজিব এদেশের মানুষের মুক্তি তথা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন বঞ্ছনা থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। কিন্তু একাত্তরের মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করলে বাংলার মুক্তিকামী জনতা ফুঁসে উঠে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও মুক্তিকামী জনতার গণআন্দোলন,স্বাধীনতার নানাবিধ প্রস্তুতি, পতাকা উত্তোলন সব মিলিয়ে পাকিস্তান বিভক্তির দিয়ে নিয়ে যায়। মুজিবকে সামনে রেখে বাংলার মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মুজিবের মুখ থেকে ‘স্বাধীনতা’ কথাটি বের করতে পারেনি সংগ্রামী ছাত্ররা। তিনি ইয়াহিয়ার আলোচনার ফাঁদে পা দিলেন। অন্যদিকে আলোচনার আড়ালে চলতে থাকে ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র জনতার উপর সামরিক আঘাত এলে জাতি ঘুরে দাড়ায় – শুরু হয় প্রতিরোধ। প্রথমে চট্রগ্রাম সেনানিবাসে পরে কালুরঘাট রেডিও থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও  যুদ্ধের ঘোষণা আসে। দেশ জড়িয়ে পড়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে। ভারত এ যুদ্ধে সরাসরি সামিল হয় ‍৩ ডিসেম্বরে, যার ১০ দিনের মধ্যেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়। ২৫ মার্চ শেখ মুজিবের আটকের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত পাকিস্তান কাঠামোর আওতায় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ন পন্থায় ক্ষমতা প্রাপ্তিই ছিলো আওয়ামীগের একমাত্র লক্ষ্য। ঐ রাতে ডঃ কামালের নিকট সেই কাঙ্খিত ফোনটি এলে হয়ত পাকিস্তানের ক্ষমতা পেতেন মুজিব, কিন্তু বাংলার মানুষ পেত না ‘স্বাধীনতা’। ইয়াহিয়া খান বাংলার মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য লেলিয়ে দিলেন সেনা। আর তার প্রতিক্রিয়াজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতেতে শেষ অবধি পাকিস্তান ভেঙ্গে জন্ম নিলো- ‘বাংলাদেশ’।

৭ই মার্চ শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন, “এ বারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” কেউ কেউ দাবী করেন ওটাই ছিলো স্বাধীনতার ঘোষণা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরে ডেভিড ফ্রষ্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুজিব এ দাবীকে নাকচ করে বলেছেন, ৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি। ঐ ভাষণের শেষে তিনি বলেছিলেন, জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান। “জয় পাকিস্তান” বলে তিনি আলোচনার পথ খোলা রেখেছিলেন। সে আলোচনাই চলে ইয়াহিয়ার সাথে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। আমেরিকার NBC টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার প্রচার হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১, তাতে মুজিবকে প্রশ্ন করা হয় Do you mean Independence? মুজিব জবাব দেন, “No, I don’t mean that, I want Autonomy।

এমনকি, সকলের অনুরোধ সত্ত্বেও আলোচনার দুয়ার ও সমঝোতার পথ খোলা রাখার জন্যেই তিনি সেই বিভীষিকাময় রাতে নিজের বাসভবন ছেড়ে কোথাও যাননি। ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে আটক হবার পূর্বে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছেন, এমন প্রচারণার পক্ষে কোনো চাক্ষুষ বা প্রত্যক্ষ কেনো প্রমান বা সাক্ষ্য নেই। আটক হওয়া অবধি মুজিবের সাথে ছিলেন তার পত্নী ফজিলাতুন্নেসা। ১৯৭৩ সালে বেগম মুজিব এক সাক্ষাৎকারে সে দিনের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেন, “…রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে তারা (পাক সেনারা) গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপরে এলো।…তারপর মাথাটা নিচু রেখে নেমে গেলেন তিনি নিচের তলায়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আবার উঠে এলেন উপরে। মেঝো ছেলে জামাল এগিয়ে দিল তার হাতঘড়ি ও মানিব্যাগ। পাইপ আর তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সাথে” (দৈনিক বাংলা, ২৬ মার্চ, ১৯৭২)। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কোথাও বেগম মুজিব একটিবারও বলেননি যে, যাওয়ার আগে কোনো এক ফাঁকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকি আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ যুদ্ধ চলাকালে বা পরবর্তীকালে কখনই জানতেন না যে, শেখ মুজিব নিজে কখনো বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বত্রিশ নম্বরে এসে মুজিবকে সম্ভাব্য আক্রমনের কথা জানাচ্ছিল। একে একে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামাল হোসেন, পাকিস্তানী সাংবাদিক তারিক আলী, ক্যাপ্টেন রহমান, আঃ রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ দেখা করেন। তারা শত অনুরোধ করেও মুজিবকে স্বেচ্ছায় কারাবরন রোধ করতে পারেন নি, বরং তিনি বাসভবন থেকে গ্রেফতার বরণের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। রাত নয়টায় ডঃ কামাল হোসেন দেখা করলে মুজিব জানতে চান, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি জেনারেল পীরজাদার কাঙ্খিত ফোনটি এসেছিলো কি না। কামালের নেতিবাচক জবাবে মুজিব হতাশ হয়ে পড়েন। এ সম্পর্কে ডঃ কামাল হোসেন লিখেছেন, “এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখনও শেখ মুজিব আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ঐ টেলিফোন পেয়েছি কিনা। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমি তা পাইনি। এ রাতেই পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙ্গালী জনগণের ওপর আক্রমন চালাল এবং গণহত্যা ও রক্তস্নান শুরু হল, যা এড়ানোই ছিল আলাপ-আলোচনা  চালানো ও  দর কষাকষির মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছানোর এখানে প্রধান লক্ষ্য” (সূত্রঃ ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল’, ডঃ কামাল হোসেন, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭)।

কি ছিলো সে সমঝোতায়?

ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে মার্চের ১৭ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত দফায় দফায় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব জানান, ফলপ্রসু না হলে তিনি আলোচনা করতেন না। এ সমঝোতা প্রসঙ্গে জানা যায়, “দুই পক্ষ অন্তবর্তী সরকার নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। বৈঠক শেষে শেখ মুজিব একজন সিনিয়র সামরিক অফিসারকে জানালেন যে, তিনি এবং ইয়াহিয়া এগারজন মন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীসহ ছয় জন আসবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে, এবং বাকী পাঁচজন আসবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে” (সুত্রঃ Richard Sisson and Leo E. Rose,1990. ‘War and Secession Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh’, University of California Press)। অত‍ঃপর ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া ও আওয়ামীলীগের প্রতিনিধিদের খুটিনাটি আলোচনা শেষে চারটি বিষয়ে ঐক্যমত হয়‍ঃ

ক) ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অনুসরনে প্রেসিডেন্টের আদেশের বলে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

খ) কেন্দ্রে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন।

গ) প্রদেশসমুহের ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ট দলের হাতে হস্তান্তরিত করা হবে।

ঘ) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা প্রথমে আলাদাভাবে বৈঠকে বসবেন, পরে পরিষদের যুক্ত অধিবেশনে সংবিধান চুড়ান্ত করা হবে (সূত্র: সাইদুর রহমান, ২০০৪। ‘১৯৭২-৭৫ কয়েকটি দলিল’ পৃষ্ঠা ৬৪)।

২৪ মার্চের পাক সরকার-আ’লীগ বৈঠকে আওয়ামীলীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ডঃ কামাল হেসেন এবং ইয়াহিয়ার পক্ষে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, এম এম আহমদ, লেঃ জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। আলোচনাকালে আওয়ামীগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নাম “ফেডারেশন অব পাকিস্তান” প্রস্তাব করলে ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি বিচারপতি কর্নেলিয়াস “ইউনিয়ন অব পাকিস্তান” পাল্টা প্রস্তাব দেন। পরে ঠিক হয়, চুক্তি সাক্ষরকালে নাম চুড়ান্ত হবে। আলোচনা শেষে স্থির হ‍য়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি জেনারেল পীরজাদা পরের দিন, অর্থাৎ ২৫ তারিখে কামাল হোসেনকে টেলিফোন করে দলিলে সাক্ষরের জন্য ডেকে নেয়া হবে। কিন্তু মুজিবকে কিছু না জানিয়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ঐ দিন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন যায়গায় সৈন্যদের গুলিতে বেশ কিছু সাধারন জনতা প্রাণ হারায়। এর প্রতিবাদে আওয়ামীলীগ ২৭ মার্চ সারা দেশের হরতালের ডাক দেয়। এটাই ছিলো ২৫ মার্চ ঘোষিত আওয়ামীলীগের সর্বশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচি। ২৫ মার্চ রাতে এ সংক্রান্তে একটি বিজ্ঞপ্তি সকল প্রেসে যায় এবং ইত্তেফাকসহ অন্যান্য পত্রিকায় ২৬ তারিখে ছাপা হয়। এ সকল আলোচনা, সমঝোতা, এমনকি ২৭ তারিখ হরতালের ঘোষণা সবকিছুই নির্দেশ করে, আওয়ামীলীগ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ক্ষমতালাভের পথে হাটছে- দেশ ভাগ বা স্বাধীনতা পেতে নয়। এ প্রসঙ্গে এন্থনী মাসক্যারেনহাস লিখেছেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১জন সংবাদবাহক স্থানীয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মাঝে ১টি প্রেসনোট বিলি করেন যেটিতে মুজিবের পক্ষ থেকে আবেদন ছিলো, “প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চুড়ান্ত হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের মতৈক্য হয়েছে এবং আমি আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষনা করবেন।” এ বিষয়ে মাসক্যারেনহাস মন্তব্য করেন, “আমার দুঃখ হয়, এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই” (সূত্র: এন্থনি মাসকারেনহাস, ১৯৭৩, ‘রেপ অব বাংলাদেশ’,  অনুবাদ‍ঃ মযহারুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১১৩)। ২৫ মার্চ রাত আটটার দিকে দলীয় সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ একটি টেপরেকর্ডার এবং ছোট্ট একটি খসড়া ঘোষণা শেখ মুজিবকে এগিয়ে দিয়ে সেটা তাকে পড়তে বলেন। তা ছিলো “বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং লড়াইয়ের আহবান।” কিন্তু মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তার ভয় ছিলো, এ কাজ করলে পাকিস্তানীরা তার বিরুদ্ধে এটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করবে। এখান থেকে দু’টি বিষয় পাওয়া যায়- ১. মুজিব স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ২. তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত হতে চান না। যুদ্ধকালে তাজউদ্দিন সাহেব তার বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসানকে এ ঘটনাটি বলেছিলেন। ঐ ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিনও পরবর্তীকালে একই ঘটনা মঈদুল হাসানকে ‍নিশ্চিত করেছেন (‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ প্রথমা প্রকাশনী ২০১০)।

২৫ তারিখের ক্রাক ডাউনের খবর শেখ মুজিব আগাম জেনে যান বিভিন্ন মাধ্যমে। মুজিব তার দলীয় নেতাকমী ও পরিবারের লোকদের আত্মগোপনে পাঠিয়ে নিজে সস্ত্রীক রয়ে গেলেন বাসভবনে এবং মধ্যরাতে তার গুছিয়ে রাখা হোল্ড-অলটি নিয়ে পাকবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেন (বেগম মুজিবের সাক্ষাৎকার ১৯৭৩)। এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট সাংবাদিক জ্যোতি সেন গুপ্ত লিখেছেন, ”২৪ তারিখে গোয়েন্দা সূত্র পাক বাহিনীর আক্রমনের আগাম সংবাদ জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগকে। কর্নেল ওসমানী ঐ দিনই মুজিবের সাথে দেখা করে তাকে অবহিত করেন। শেষ রাত পর্যন্ত নেতারা করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, তারা আত্মগোপন করবেন এবং পালিয়ে ভারতে চলে যাবেন।” কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাজউদ্দিন এসে দেখেন মুজিব তার বিছানাপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে আছেন। মুজিব তাকে বললেন যে, তিনি থেকে যাবেন- গ্রেপ্তার বরণ করবেন (সূত্রঃ মাসুদুল হক, দৈনিক ইনকিলাব ২৬ মার্চ ২০০৫)। আটকের পর থেকে পরবর্তী তিন দিন মুজিবের অবস্থান কার্যত ছিলো অজ্ঞাত। অনেকেরই ধারনা ছিলো, মুজিব আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইটে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে উল্লেখ করে, “Yahya Khan left Daca abruptly on 25 March 1971 and Tikka Khan let loose his reign of terror the same night. The next day, while the whereabouts of Mujib remained unknown, Major Ziaur Rahman announced the formation of the Provisional Government of Bangladesh over Radio Chittagong”.

pak_bharot2অর্থাৎ মুজিবের নিখোঁজ অবস্থায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার কাজটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। অনেকে আজ প্রশ্ন তুলেছেন- মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষনার কতৃত্ব নিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা সত্বেও গণমানুষের দাবী- ‘স্বাধীনতা’, যা একজন সৈনিকের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে- এটাই বাস্তবতা। সময়ের দাবী কোনো পার্লামেন্টের পাশ করা আইন বা ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করে না। পাকবাহিনীর অন্যায় ও অমানবিক আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য সাড়ে সাত কোটি জনতার কাঙ্খিত স্বাধীনতা যুদ্ধ করে আদায়ের লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিলো একটি ডাকের। আর সে ডাকই আসে চট্টগ্রাম থেকে। পক্ষান্তরে, আওয়ামীলীগের প্রস্তুতি এবং স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানা যায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান তরফদারের বর্ণনায়, “ফেব্রুয়ারী বা সম্ভবতঃ তার আগে থেকেই যে সমর প্রস্তুতি শুরু, তার অবশিষ্ট আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ধুম্রজাল বিস্তার করা হয়। এই আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যুগপৎ সন্দিহান ও আশাবাদী থাকায় আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের পক্ষে আসন্ন সামরিক হামলার বিরুদ্ধে যথোপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবতঃ একই কারণে ২৫/২৬ মার্চের মধ্যরাতে টিক্কার সমর অভিযান শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। শেষ মুহুর্তে আওয়ামীলীগ নেতা ও কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েও সহকর্মীদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব রয়ে গেলেন নিজ বাসভবনে। সেখান থেকে গ্রেফতার হলেন হত্যাযজ্ঞের প্রহরে” (সূত্রঃ মুলধারা ৭১)। শেখ মুজিব কি করে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হলে সে সম্পর্ক পরিস্কার একটা বর্ণনা পাওয়া যায় লন্ডন টেলিগ্রাফের ঢাকা প্রতিনিধি Simon Dring ৩০ মার্চ ১৯৭১ এর HOW DACCA PAID FOR A UNITED’ PAKISTAN শিরোনামে টেলিগ্রোমে ”Mujib’s arrest: As this was going on. other units had surrounded the Sheikh’s house. When contacted shortly before 1 a.m. he said that he was expected an attack any minute and had sent everyone except his servants and bodyguard away to safety. A neighbor said that at 1-10 a.m., one tank, an armored car, and trucks loaded with troops drove down the street firing over the house. “Sheikh you should come down”, an officer called out in English as they stopped outside. Mujibur stepped out onto his balcony and said. “Yes. I am ready, but there is no need to fire. All you need to have done is call me on the telephone and I would have come”. The officer then walked into the yard and told Mujibur: “You are arrested” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ৭৯০). এই রিপোর্টের কোথাও সাইমন একটি শব্দ বলেন নি যে, মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন।

লেখক: মোঃ শামসুল আলম
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

   

    ইতিহাসের কাঠগড়ায় শেখ মুজিব -২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *