অবিস্মরণীয় জিয়া

imageআমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। পৃথিবীর অপরাপর সৃষ্টির ওপর আমাদের রয়েছে আধিপত্য। সৌরমণ্ডলের সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র প্রভৃতির তাপ ও আলো নিয়োজিত রয়েছে আমাদেরই কল্যাণে। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই সমানভাবে ভোগ করি এসব নিয়ামত। কবি নজরুলের ভাষায়ঃ
তাঁহার চন্দ্র, সূর্যের আলো করে না ধর্মভেদ
সর্ব জাতির ঘরে আসে, কই আনে না তো বিচ্ছেদ।

কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, স্রষ্টার মহিমায় লালিত মানব প্রজাতির মধ্যে মানুষের মতো মানুষ ক’জন? ক’জন মানুষ আপন কাজের মাধ্যমে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন তাঁর সময়কে? ক’জন পেরেছেন শ্রম, মেধা দিয়ে এমনকি নিজের জীবন দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে? ক’জন পেরেছেন ইতিহাসের কালজয়ী অধ্যায়ে নিজের নাম যুক্ত করতে? ক’জন মানুষের মৃত্যুর পর বিশ লাখ লোক হয়েছে জানাযায়? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, কোটি কোটি মানুষের ভিড় খুব কমসংখ্যক মানুষের বেলাতেইতা হয়েছে।

আজ এমন একজন মানুষের কথা বলব যিনি সারা জীবনই ছিলেন মুজাহিদ। ন্যায়ের যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরেছেন গাজীর বেশে। আবার ন্যায়ের যুদ্ধেই তিনি হয়েছেন শহীদ। শহীদ শব্দটি হচ্ছে মানব জাতির কাছে পবিত্র গর্ব। একজন মানুষের জীবনে একই সঙ্গে মুজাহিদ, গাজী ও শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য অনন্য বিরল ঘটনা। মানুষের মতো মানুষএই বীরের নাম শহীদ জিয়াউর রহমান। আমাদের অন্তরের গভীরে গেঁথে আছে এই নাম। বাংলাদেশের পলিমাটিতে এখনো উজ্জ্বল তাঁর পায়ের ছাপ, নদী-নালা-সমুদ্র তাঁর কর্মক্লান্ত দেহের প্রতিচ্ছবি, বাতাসে কান পাতলে আমরা এখনো যেন শুনতে পাই তাঁর অভয়জড়িত নির্ঘোষ কণ্ঠ ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’।

কেন অনন্য তিনি? কেন স্বরণীয় এই নাম? বহু কারণ আমাদের দুর্যোগে, সংকটে বার বার জীবন বাজি রেখে এগিয়ে এসেছেন তিনি মানুষের পাশে, দেশের কাজে।

একাত্তরের ২৫ মার্চ সেই ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র এই জাতির ওপর। হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন চালাল অবাধ গতিতে। প্রতিরোধকামী মানুষ উন্মুখ হয়ে প্রহর গুণছিল রুখে দাঁড়াতে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এল কোটি কোটি মানুষের অন্তরের প্রতিধ্বনি। স্বাধীনতার ঘোষণা। ঘোষণা করলেন জিয়াউর রহমান। মুহূর্তের মধ্যে স্বাধীনতার সেই বাণীর সঙ্গে সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে গেঁথে গেল এই নাম। বুকে জাগিয়ে তুললো দুর্জয় সাহস। এই জাতির চিরকালের শ্রেষ্ঠ সময়ের সর্বোত্তম শব্দটি উচ্চারণ করে জিয়াউর রহমান অবিভাজ্য হয়ে গেলেন এই দেশ, মাটি ও এই মানুষের সঙ্গে। তারপর স্বাধীনতার জন্য নয় মাসব্যাপী রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ। যুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি আবার ফিরে গেলেন তার সাদাসিধে সৈনিক জীবনে। কিন্তু সংকট বাকি ছিল আরো।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। জাতির এক অস্থির ও অনিশ্চিত সময়। চারদিকে সংঘর্ষ, বিশৃংখলা আর হতাশা। প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা বিপন্নের মুখোমুখি। দিশেহারা জাতির কাণ্ডারি হয়ে আবার এলেন জিয়াউর রহমান। জিয়ার সেই সাহস জাগানিয়া কণ্ঠ আবার উচ্চারণ করল, ‘আমি জিয়া বলছি ……….।’

সিপাহী-জনতার যৌথ বিপ্লব জিয়ার জন্য ছিনিয়ে নিয়ে এল গৌরবের শিরোপা। জনগণকে সঙ্গে করে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার কঠোর-কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিলেন তিনি। তারপরের ইতিহাস জনগণের উজ্জীবনের ইতিহাস। দেশ ও মাটির সঙ্গে জিয়ার চিরস্থায়ী সেতু রচনার ইতিহাস, জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়ানো এক দীক্ষার ইতিহাস। ঘাতকদের বুলেটে শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জিয়ার প্রতিটি নিঃশ্বাস অবিচল ছিল দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য।

কেমন ছিলেন জিয়াউর রহমান? কীভাবে জাগ্রত হলো তাঁর বুকে সীমাহীন দেশপ্রেম? কীভাবে লড়াইয়ের পর লড়াই করেছেন দেশ ও জনগণের জন্য?

জিয়ার ডাকনাম ছিল কমল।১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জনাব কামাল উদ্দীন । পিতামহের নাম মিসিরন নেসা। জিয়া ছিলেন তাঁর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।

জিয়ার পিতা জনাব মনসুর রহমান ছিলেন একজন কেমিস্ট। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে তিনি ছিলেন কলকাতায়। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি চাকরিসূত্রে করাচীতে চলে যান। জিয়ার মা জাহানারা খাতুন ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী। তিনি নজরুল সঙ্গীত গাইতেন। করাচী বেতারে এক সময় নিয়মিত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করতেন। জিয়ার স্কুলজীবন শুরু কলকাতার হেয়ার স্কুলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি দু’বছর বগুড়ায় তাঁর গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেন। এরপরে স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে করাচীতে। ১৯৫২ সালে তিনি করাচী একাডেমী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন করাচী ডি. জে. কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

বাল্যকালে তিনি ছিলেন খুব লাজুক ও গম্ভীর প্রকৃতির। কথা বলতেন কম। সব কিছুই খুব মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতেন। জীবন যাপন করতেন খুব অনাড়ম্বরভাবে। তাঁর সানী চোখ গভীরভাবে অবলোকন করত চারপাশের জীবন ও জগতকে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিদ্বেষ ও অবজ্ঞা খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি বুঝতে শুরু করেন। এসব দেখে তাঁর মনোজগতে একটা বিদ্রোহের ভাব জাগতে শুরু করে। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই পরবর্তীকালে লিখেছেনঃ

“স্কুল জীবন থেকেই পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা আমার মনকে পীড়া দিতো। আমি জানতাম, অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা ক। স্কুল জীবনে বহুদিনই শুনেছি আমার স্কুল-বুদের আলোচনা। তাদের অভিভাবকরা বাড়িতে যা বলতো তাই তারা রোমন্থন করতো স্কুল-বুদের আলোচনা। আমি শুনতাম মাঝে মাঝেই। শুনতাম তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হতো বাংলাদেশকে শোষণ করার্‌ পাকিস্তানী তরুণ সমাজকেই শেখানো হতো বাঙালিদের ঘৃণা করতে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেওয়া হতো স্কুলছাত্রদের শিশু মনেই। স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হতো তাদের বাঙালিকে নিকৃষ্টতর মানবজাতিরূপে বিবেচনা করতে। অনেক সময় আমি থাকতাম নীরব শ্রোতা । আবার মাঝেমধ্যে প্রত্যাঘাত হানতাম আমিও। সেই স্কুল জীবন থেকেই মনে মনে আমার একটা আকাঙ্ক্ষাই লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে তাহলে এই পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বেই আমি আঘাত হানবো। সযত্নে এই ভাবনাটিকে আমি লালন করতাম। আমি বড় হলাম। সময়ের সাথে সাথে আমার সেই কিশোর মনের ভাবনাটাও পরিণত হলো। জোরদার হলো। পাকিস্তানী পশুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার দুর্বারতম আকাঙ্ক্ষা দুর্বার হয়ে উঠতো মাঝে মাঝেই উদগ্র কামনা জাগতো পাকিস্তানের ভিত্তিভূমিটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু উপযুক্ত সময় আর স্থানের অপেক্ষায় দমন করতাম সেই আকাঙ্ক্ষাকে।”

শহীদ জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্মকাণ্ডকে আমরা চারটি ভাগে দেখতে পারি। অবশ্য এর প্রতিটি ভাগই অপরগুলোর সঙ্গে যুক্ত।

চারটি ভাগই হচ্ছেঃ 

ক. সৈনিক জিয়া
খ. ব্যক্তি জিয়া
গ. রাষ্ট্রপতি জিয়া
ঘ. রাজনীতিক জিয়া

সৈনিক জিয়ার জীবন আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁর জীবন যে কোনো সৈনিকের জন্য শ্রেষ্ঠ স্বপ্নের জীবন হতে পারে্‌ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম দায়িত্ব। জিয়া ছিলেন সেই ভাগ্যবান সৈনিক যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রথম ডাক দিয়ে নিজেও অবতীর্ণ হয়েছেন সেই যুদ্ধে। জাতির ইতিহাসে তাই সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ সৈনিক হয়ে থাকবেন তিনি।

ব্যক্তি জীবনে জিয়াউর রহমান যে সততা এবং আদর্শ তুলে ধরেছেন তা সর্বকালেই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সবচাইতে সাধারণ খাবার খেয়ে একেবারে অল্প সংখ্যক ও অল্প দামের কাপড় এবং অন্যান্য আসবাবপত্র ব্যবহার করতেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হয়েও পুরনো স্যুটকেস রশি বেঁধে ব্যবহার করতেন। বেতনের একটা অংশ জমা দিয়ে দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। মৃত্যুর সময় রাজধানীতে তাঁর নিজের কোন বাড়ি ছিল না। পরিশ্রম করতেন সকাল থেকে রাত একটা পর্যন্ত।

পাঁচ বছরের রাষ্ট্রপতি জীবনে তিনি নিরলস ও সততার মাধ্যমে জাতিকে পরিচালিত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ কেউ তুলতে পারেনি। তিনি আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রপতি। জনগণের সঙ্গে তিনি গড়ে তুলেছিলেন একেবারে সরাসরি সম্পর্ক। দেশ ও জাতিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর প্রতিজ্ঞা থেকে তিনি ক্ষণিকের জন্যও সরে যাননি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা তিনি পূরণ করেছিলেন কানায় কানায়। রাজনীতিতে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। জাতির ঘোরতর বিপর্যয়ের দিনে ঐক্য ও ভারসাম্যের প্রতীক হয়ে তিনি রাজনীতিতে আসেন। সিপাহী-জনতার বিপ্লব তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক ঐতিহাসিক দায়িত্বের মুখোমুখি। তিনি পিছিয়ে যাননি।

সৈনিক জিয়া
১৯৫৩ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরও জিয়াকে অনেক বিরূপ অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছে। জিয়া স্বজাতির সম্মানের প্রশ্নে কখনো পিছিয়ে আসেন নি। একদিন কতগুলো পাকিস্তানী ক্যাডেট এ দেশের জাতীয় নেতা ও জাতীয় বীরদের গালাগাল করল, বিশ্বাসঘাতকও বলল। জিয়ার সঙ্গে এ দেশের অনেকেই তখন এর প্রতিবাদ করেন। তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয় এ নিয়ে, পরে সিদ্ধান্ত হলো মুষ্টিযুদ্ধ করে যে জিতবে তার কথাই বলে ধরে নেয়া হবে। জিয়া আমাদের জাতি এবং জাতীয় বীরদের সম্মান রক্ষা করার জন্যে বক্সিং গ্লাভস হাতে তুলে নিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে বক্সিং গ্লাভস পরে এগিয়ে এল লতিফ নামের একজন ক্যাডেট। মুষ্টিযুদ্ধ দেখার জন্য প্রচুর দর্শক উপস্থিত হলো। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধ শুরুর আধা-মিনিটের মাথায়ই ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল পাকিস্তানীপন্থী লতিফ। জিয়ার এই বিজয় ছিল একটি পূর্বাভাস। তিনি সেদিনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের চূড়ান্ত মীমাংসাটা হবে লড়াইয়ের মাধ্যমে। ঠিক এইভাবেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ জাতির কাছে মাথা নত করে পাকিস্তানী বাহিনী।

জিয়া সেনাবাহিনীতে থাকতেই দেখতে পেয়েছিলেন এ দেশের সন্তানদের প্রতি পাকিস্তানের অবহেলা ও অবিচার। ১৯৬৩ সালে জিয়া ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে। সে সময় পাকিস্তানী এক মেজর জেনারেল তাঁর এলাকা পরিদর্শনে আসেন। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি জিয়ার মতামত জানতে চাইলে জবাবে জিয়া বলেন যে, এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হলে প্রশাসন চালু রাখা কঠিন হবে। তাঁর কথা শুনে মেজর জেনারেল বলেন, “এরা যদি স্বনির্ভর হয় তাহলে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে।” একথা শুনে জিয়া বুঝতে পারেন যে, এদের সঙ্গে থাকলে এ দেশের উন্নতির কোন আশা নেই।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় জিয়া ছিলেন খেমকারান সেক্টরে ‘আলফা কোম্পানীর একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার। এই ব্যাটালিয়ন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করায় লাভ করেছিল দ্বিতীয় সর্বাধিক বীরত্ব পদক। যুদ্ধের সময় বহু পাকিস্তানী সৈন্য পালিয়ে গেলেও এ দেশের কোন জওয়ানই পালায়নি। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ‘বাঙালিরা ভালো সৈনিক নয়’ এই অপবাদ ঘুচিয়েছে।

১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে জিয়া পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে প্রশক্ষিকের পদে যোগ দেন। সেখানেও তিনি দেখতে পান বাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞা ও বঞ্চনা। এই পর্যায়ে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ সময় তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনাও করেন। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চার মাসের প্রশিক্ষণ নিতে পশ্চিম জার্মানীতে চলে যান।

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর জিয়াকে নিয়োগ করা হয় চট্টগ্রামে, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়লাভ করে। একাত্তরের মার্চ মাসের গোড়া থেকে পাকিস্তানীরা জিয়ার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য লোক নিযুক্ত করে। তাঁর সম্পর্কে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে। জিয়া আশংকা করতে থাকেন সব বাঙালি সৈন্যের অস্ত্র শস্ত্র হয়তো কেড়ে নেওয়া হবে। সে অবস্থায় কী করতে হবে তাও তিনি মনেমনে ঠিক করে ফেলেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কী করতে হবে জানতে চান। মার্চ মাসের ৪ তারিখে তিনি ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে পাঠান। আলোচনায় বসেন তাঁর সঙ্গে। জিয়া তাঁকে সোজাসুজি বলেন, “সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।” এরপর তাঁরা যুদ্ধ শুরু পূর্ব পর্যন্ত প্রতিদিন বৈঠকে বসে পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণের পর তাঁরা চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেন আঘাত হানায়। ১৩ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান আলোচনায় বসার পর অবশ্য প্রস্তুতিতে কিছুটা ভাটা পড়ে। তাঁরা মনে করেছিলেন আলোচনার মাধ্যমে হয়তো নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আলোচনা ছিল ইয়াহিয়া খানের খুটচাল। একদিকে আলোচনা চলছিল, অন্যদিকে এখানে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আসতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর শক্তিও বৃদ্ধি করা হয়। ১৭ মার্চ জিয়া আরো কিছু বাঙালি সেনা অফিসার নিয়ে গোপন বৈঠক করলেন, চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের কাছে। সবাই মিলে তৈরি করলেন একটি চূড়ান্ত যুক্ত-পরিকল্পনা। পরে চট্টগ্রামে অবস্থিত ইপিআর বাহিনীকেও পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ২১ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ সফরে এলেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। তাঁর সফরের উদ্দেশ্য ছিল এ দেশের মানুষের ওপর ক্ষিপ্রগতিতে কীভাবে আক্রমণ চালানো হবে তা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা অফিসারদের বুঝিয়ে দেওয়া। এই গোপন চক্রান্তের কথা জিয়া শুনে ফেলেন।

এল সেই কালো রাত। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী কালোরাত। রাত ১টা- জিয়ার কমান্ডিং অফিসার জিয়াকে আদেশ দিলেন নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী জেনালের আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। আসলে এটি ছিল একটি ফাঁদ। জিয়াকে হত্যা করার জন্য এই ফাঁদ রচনা করা হয়। জিয়া তা বুঝে ফেলেন। তাই তিনিও মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে বন্দরের পথে বের হলেন। আগ্রাবাদ এসে দেখলেন জনতা পথে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। জিয়া ব্যারিকেডের কাছে নেমে রাস্তায় পায়চারী করতে করতে চিন্তা করছিলেন। এ সময় সেখানে ক্যাপ্টেন অলি আহমদের গোপন বার্তা নিয়ে এলেন মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। তিনি জিয়াকে রাস্তার একপাশে ডেকে নিয়ে কানে কানে বললেন, “তারা অর্থাৎ পাকিস্তানীরা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে।” শুনে জিয়া দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বললেন, “আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানী অফিসারদের গ্রেফতার করো। অলি আহমদকে বলো, ব্যাটালিয়ন তৈরি রাখতে আমি আসছি।”

জিয়া নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে গেলেন। সেখানে বসা পাকিস্তানী অফিসার, নৌবাহিনীর চীফ অফিসার ও ড্রাইভারকে বললেন যে, বন্দরে আর যাওয়ার দরকার নেই। তাঁরা আবার ফিরে চললেন শহরের দিকে। জিয়ার মাথায় তখন দ্রুত চিন্তা চলছিল কী ভাবে ট্রাকের পাকিস্তানী সৈন্যদের কাবু করা যায়। ষোলশহর বাজারের কাছে আসার পর জিয়া ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে রাইফেল তুলে ধরলেন পাকিস্তানী সৈন্যদের দিকে। সংখ্যায় তারা আটজন। জিয়া সবাইকে মাথার ওপর হাত তুলতে নির্দেশ দিলেন। সবাই ভয়ে তাঁর নির্দেশ পালন করল। জিয়া কমান্ডিং অফিসারের জীপ নিয়ে সেই অফিসারের বাসায় রওয়ানা হলেন। পৌঁছে কলিংবেল টেপার পর কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বের হয়ে এল। জিয়া ক্ষিপ্‌্র-গতিতে ঘরে ঢুকে অফিসারের কলার চেপে ধরে বললেন, “বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। এখন বিনা বাক্যে আমার সঙ্গে এসো।”

কমান্ডিং অফিসার ভয়ে জিয়ার নির্দেশ পালন করল। জিয়া তাকে তাঁর ব্যাটালিয়নে নিয়ে এলেন। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে জিয়া মেজর শওকতকে ডাকলেন। কাছে আসার পর শওকতকে বললেন, “আমরা বিদ্রোহ করেছি।” শুনে শওকত তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। ব্যাটালিয়নে ফিরে তিনি দেখলেন সব পাকিস্তানী অফিসারকে বন্দী করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। তিনি অফিসে গিয়ে চট্টগ্রামের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু পাওয়া গেল না, তারপর রিং করলেন বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাঁকে অনুরোধ করলেন চট্টগ্রামের ডিসি, এসপি, কমিশনার, জিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের এটা জানাতে যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। তখন সময় ছিল অতি মূল্যবান। জিয়া ব্যাটালিয়ন অফিসার, জেসিও এবং জোয়ানদের ডাকলেন, ভাষণ দিলেন তাদের উদ্দেশ্যে। আহ্বান জানালেন সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। সবারই অন্তরে তখন একই আওয়াজ। জিয়া তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা দিলেন।

রাত তখন ২টা বেজে ১৫ মিনিট। এর কতক্ষণ আগে পাকিস্তানীরা বন্দী করে শেখ মুজিবুর রহমানকে।‌ রাজনৈতিক নেতারা যে যার সুবিধা মতো আত্মগোপন করেন। পাকিস্তানীদের নারকীয় ধ্বংসকাণ্ডে জাতি যখন বিহবল, দিকচিহ্নহীন ও সংশয়ের দোলায় দুলছে, সেই কঠিন সময়ে অনিশ্চয়তার আঁধার ভেদ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ভেসে আসে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাঃ

“প্রিয় দেশবাসী,

আমি মেজর জিয়া বলছি। …. আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আপনারা দুশমনদের প্রতিহত করুন। দলে দলে এসে যোগ দিন স্বাধীনতার যুদ্ধে। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় দেশের উদ্দেশ্যে আমাদের আহ্বান, আমাদের ন্যায় যুদ্ধে সমর্থন দিন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। ………. ইনশাল্লাহ বিজয় আমাদের অবধারিত।”

সংকটের সেই অমানিশায় জিয়ার ভয়তাড়ানিয়া ও সাহস জাগানিয়া সেই ‘দৃপ্ত উচ্চারণ বাংলাদেশ ও তার জগণকে এগিয়ে নিয়ে গেল বিজয়ের দিকে। এই ঘোষণার কারণে শত্রুকবলিত দেশে তাঁর কি ঘটতে পারে সে তোয়াক্কা তিনি করলেন না। কারণ তাঁর বুকভরা দেশপ্রেম ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘হুব্বল ওয়াতন মিন আল ঈমান’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি নিযুক্ত হন সেক্টর কমান্ডার। তাঁর নামে ‘জেড ফোর্স’ নামক একটি বাহিনীও গড়ে ওঠে। তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান ঢাকা সেনানিবাসে বী ছিলেন। সে বন্দীজীবন ছিল দুঃসহ। জিয়া তাঁর স্ত্রী ও পুত্রদের জীবন বিপন্ন জেনেও অবিচল ছিলেন শত্রুদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানীরা তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করে হুমকি পাঠাত যে, যে কোনো মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের হত্যা করা হবে। জিয়া এই মানসিক চাপ নিয়েই অবিচলভাবে দেশের জন্য যুদ্ধ করেন। এ নিয়ে প্রকাশ্যে তিনি দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতেন না, যাতে সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। যুদ্ধ শেষ হবার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরোত্তম খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর প্রথমে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি ব্রিগেডের কমান্ডার করা হয়। ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তিনি সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর দেশে দেখা দেয় আরেকটি বড় সংকট। সেদিন খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। জিয়াকে বন্দী রাখা হয় ঢাকা সেনানিবাসে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ভার অর্পণ করেন বিচারপতি এ এস এম সায়েমের কাছে। চারদিকে অনিশ্চয়তা আর হতাশা। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে দেশের মানুষ। এ অবস্থায় সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে অভ্যুত্থানকারীরা পরাভূত হয় এবং জিয়াকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে আনা হয়। দেশে জারি হয় সামরিক শাসন। জিয়া উপ-প্রধান সামরিক আইন-প্রশাসক হিসেবে আবার জাতির সামনে উপস্থিত হন অভয়বাণী নিয়ে। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বলেনঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

প্রিয় দেশবাসী,
আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভূত্থানে সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কেউ নস্যাৎ করতে পারবে না ইনশাল্লাহ। আপনারা নিঃশঙ্কচিত্তে যার যার কাজে যোগ দিন।”

জিয়ার কণ্ঠ শুনে জনগণের মধ্যে আবার আস্থা ফিরে আসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কোটি কোটি মানুষ। ইতিহাসের দু’টি ঘোরতর সঙ্কটে ও স্পন্দনে তিনি বীরের মতো এগিয়ে এসে জয় করে নেন জনতাকে। জনগণ ক্রমান্বয়ে তাঁর হাতে তুলে দেয় শাসনের ন্যায়দণ্ড। হয় জিয়ার জীবনে আরেক কঠিন পরীক্ষা। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন।

রাষ্ট্রপতি  রাজনীতিক জিয়া 
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়া প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর ৪০ দিন পর ‘হাঁ’ ও ‘না’ আস্থা ভোটে বিপুলভাবে জয়লাভ করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে তিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগে তাঁর অনুপ্রেরণায় গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল। পরে আরো কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এই ফ্রন্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি-তে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ২২০টি আসন লাভ করে। জিয়া দেশবাসীর কাছে ১৯দফা কর্মসূচি পেশ করেন। দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। জিয়া দেশ ও জাতির অনিবার্য তাগিদে দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছেন। রাজনীতিতে যখন আসেন তখন ভাববারও সময় পাননি। কিন্তু এরপরও তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিক। তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রবর্তন করলেন বহুদলীয় রাজনীতি। তাঁর দেশপ্রেম ও জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তাঁকে সাফল্যের পর সাফল্য এনে দিয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বসেও তিনি কঠিন পবিত্রতার মধ্যে বাস করেছেন। কোনো দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি তাঁকে ছুঁতে পারেনি।

তিনি এই জাতিকে জাতীয়তাবাদের নির্দিষ্ট পরিচয়ে পরিচিত করেছেন। এর নাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। জনগণের উত্থান-পতন ও স্পন্দনে জিয়া জনতার সঙ্গে ছিলেন। তাঁর আমলে দেশে স্থিতি আসে। এর আগের আমলের নৈরাজ্যকর অবস্থা কাটিয়ে তিনি জাতিকে একটি ভবিষ্যৎ লক্ষ্য উপহার দিয়েছেন। জিয়ার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। এই জাতি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। বিদেশী সাহায্যের জন্য যেন অপেক্ষা করতে না হয়। তিনি নিজে বলেছেন, “আমাদের নয় কোটি মানুষের আঠারো কোটি হাত এক সাথে কাজ করতে হবে। নারী-পুরুষ সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে কেউ সাহায্য করবেনা। মাথার বুদ্ধি এবং হাত কাজে লাগাতে হবে দেশকে নির্মাণের জন্য। এ দেশের সমস্যার সমাধান এ দেশের মাটিতেই রয়েছে। সাধারণ মানুষকে বাদ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না।”

গ্রামের মানুষের সঙ্গে জিয়া সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। বঙ্গভবনের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে তিনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত গ্রাম থেকে গ্রামন্তরে উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন, খোঁজ-খবর নিয়েছেন। কি করলে দেশের ভাল হবে, গ্রামের মানুষের ভাল হবে তা তাদের কাছে জানতে চেয়েছেন। এক সাথে ৫/৬ মাইল হাঁটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। একবার একনাগাড়ে ২২ মাইল হেঁটে শুধু ডালভাত খেয়েও তিনি ছিলেন অক্লান্ত। কখনো দেখা গেছে গ্রামের স্কুলের দু’টি টুল একত্র করে তাতেই ঘুমুচ্ছেন জিয়া। মনে হতো যেন একখণ্ড বাংলাদেশ নিদ্রা যাচ্ছে দু’টি টুলের ওপর। শুধু গেঞ্জি পরে খালি পায়ে খালে মাটি কেটেছেন। কক্সবাজারে পাতালীখাল কাটতে গিয়ে মজুরদের সঙ্গে মাটির বাসনে ভাত খেতে বসে গেছেন, পানি পান করেছেন মাটির গ্লাসে। অফুরন্ত প্রাণশক্তি দিয়ে উৎসাহিত করতেন অন্যদের।

গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন এ দেশের সোনাফলা প্রতি ইঞ্চি মাটিকে কাজে লাগাতে হবে। অল্প আয়াসে কৃষকরা গাছ-গাছালি, হাঁস-মুরগী, ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের মান উন্নত করতে পারেন। জিয়া এসব ব্যাপারে কৃষকদের শুধু যে উৎসাহ দিতেন তা নয়, মাঝে মাঝে আরো সহজ পথ ধরতেন। গাঁয়ের কোন এক গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে বসতেন, “কই, আপনাদের হাঁস-মুরগী কই? আপনার এত বড় উঠান, এতো জায়গা চারপাশে। দেখি আপনার ঘরে মেহমানের জন্য কতগুলি ডিম আছে? গাছ-গাছালি লাগান নাই কেন? কলা, পেঁপে আনারস( আমি আপনাদের মেহমান হয়ে এলাম, আমাকে এখন কী খেতে দিবেন?”

এসব কথা কৃষকদের অন্তরে পৌঁছে যেত। দুপুরের কড়া রোদে, ঝড়ো হাওয়ায়, বৃষ্টিতে গ্রামের দুর্গম পথে তিনি অনায়াসে হেঁটে যেতেন। দরিদ্র কিষাণের কুটির প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেন, যেন পরম বু।

চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন জিয়া সম্পর্কে লিখেছেন এক দিনের কথা। এখানে তা তুলে ধরছিঃ “খালকাটা উদ্বোধন করতে গিয়ে একদিন এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেন। খুব সাধারণ ভাব-ভঙ্গি নিয়েই বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। চোখে খুব কম দেখেন। বললেন,

– তুমি কে গো বাবা?
– আমি জিয়াউর রহমান

বৃদ্ধা এসে জিয়া জিয়া বলে সস্নেহে তাঁর চোখ-মুখ হাতড়াতে লাগলেন এবং বললেন,

– আমার মতো গরিব মাইনষের কাছে কী চাও বাবা?

প্রায় কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধা।

জিয়াউর রহমান মার কাছে কথা বলার মতোই বললেন,

– মাগো খাঁ খাঁ দুপুর, একটু লেবুর শরবত খাবো।

বৃদ্ধা আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠলেন,

– বাবারে, আমার ধন, আমার বাড়িতে যে লেবু নাই, কী খাওয়াই, খালি মুখে তো তোমারে যাইতে দিমু না। বৃদ্ধা যেন কিছু খাবার খুঁজতে থাকেন।

জিয়াউর রহমান যেন মার সঙ্গে দুষ্টুমি করে বলছেন, “মাগো তোর সঙ্গে দুষ্টুমি করছিলাম, আগামী বছর আসব। তুই আমার জন্য লেবু গাছ বুনবি। আমি সেই লেবু গাছের লেবু দিয়ে তোর হাতের শরবত খেয়ে যাব।”

জিয়া একটি ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন সুপরিচিতি ও সম্মানযোগ্য আসন লাভ করেছিলেন। এর কারণ, নিজের দেশ সম্পর্কে তাঁর ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা ও গর্ব। তিনি বলেছেনঃ

“ছোট দেশ হলেও মনটা ছোট হবে কেন? আমাদের বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ হলেও আমাদের মনটা বড় করতে হবে। আর এই মনটা বড় করতে পারলে দেশটাও বড় হতে পারবে। এই মনটাকে বড় করতে হলে আবার কথায় ও কাজে এক হতে হবে, সৎ ও একনিষ্ঠ হতে হবে। এ জন্যও আবার কথা কম ও কাজ বেশি করতে হবে। তাহলেই আমরা বড় হয়ে উঠতে পারব।”

জিয়া বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন হতলাঞ্ছিত দরিদ্র বাংলাদেশকে। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য সার্ক গঠনের তিনিই ছিলেন মূল রূপকার।

জিয়া অনেক কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু তিনি পারবেন এই বিশ্বাস তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের ছিল। এই বিশ্বাস অর্জনই হচ্ছে যে কোন রাষ্ট্রনায়কের প্রধান সাফল্য। জিয়া সেই বিরল সাফল্যের অধিকারী।

ব্যক্তি জিয়া 
জিয়া ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু জনসাধারণের কাছে গেলে তিনিও একেবারে সাধারণ হয়ে যেতেন। তাঁর নিজের জীবন-যাপনও ছিল অতি সাধারণ। একটি তরকারি, ডাল আর ভাত। মাছ ও মাংস একসাথে খেতে দিলে তিনি রেগে যেতেন। একবার তিনি জেলা পরিদর্শনে গেলেন। জেলা প্রশাসক তাঁর জন্য অনেক খাবার আয়োজন করায় তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এর জন্য টাকা কে দিয়েছে।” যখন জানতে পারেন সরকারি টাকা দিয়ে বিপুল আয়োজন করা হয়েছে, তখন তিনি রেগে গেলেন। বললেন, “আমরা বিয়ের দাওয়াত খেতে আসিনি। ভবিষ্যতে এমন করবেন না।”

জিয়ার অনেক সফরসঙ্গী খাওয়ার অপ্রতুলতার জন্য হতাশ হতেন। তাঁর বাসায় গেলে যা খেতে দেয়া হতো কেউ কেউ তাকে বলতেন। ‘পানিশড ফুড’ বা শাস্তিমূলক খাবার। অর্থাৎ অত্যন্ত সাদাসিধে খানা তৈরি হত বাসায়। বিলাসিতা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। তাঁর কর্মে ও জীবনধারণে ছিল মহামানবের মহত্ত্ব।

জিয়া শহীদ হবার পর সার্কিট হাউসে তাঁর মালামালের মধ্যে পাওয়া যায় একটি রংচটা টিনের স্যুটকেস, দুটি সাফারী সার্ট, একটি প্যান্ট, একটি আধাছেঁড়া গেঞ্জি, একটি অতি সাধারণ টুইনওয়ান, একটি পুরনো ব্রিফকেস, একটি সাদা গোলটুপি ও জায়নামায।

শুধু নিজের বেলায় নয়, ছেলেদের জন্যও কোনো বিলাসী জামা-কাপড়ের আয়োজন ছিল না। এমনও দেখা গেছে জিয়ার প্যান্ট পুরনো হয়ে যাওয়ার পর সেগুলো কেটে ছোট করে ছেলেদের পরতে দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ও স্ত্রীর হাতে তিনি খুব সামান্য টাকাই দিতে পারতেন। ছেলেদেরও কাপড়-চোপড়ে মিতব্যয়ী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। জিয়া পাঁচ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করেছেন। কিন্তু তাঁর ছেলেরা কোনদিন বঙ্গভবনই দেখেন নি। কেউ তাঁর সঙ্গে বিদেশেও যান নি। বেগম খালেদা জিয়াকেও টেলিভিশনে আলাদাভাবে দেখানো হয়নি। নিজের আত্মীয় বা পরিবারের জন্য আলাদা কোনো সুযোগ তিনি নিতে চাইতেন না। তাঁর ছেলেরা যে স্কুলে পড়ত সেখানকার শিক্ষক-ছাত্রদের অনেকেও জানতেন না যে এখানে প্রেসিডেন্টের ছেলে পড়ে।

তিনি রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তাঁর ছেলে পরীক্ষায় খারাপ ফল করে। তাই তাকে আগের ক্লাসেই থাকতে হয়। জিয়া কোন প্রভাব বিস্তার করেন নি। জিয়া তদবির পছন্দ করতেন না।

আরেকদিনের ঘটনা। জিয়ার দুই ছেলে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নতুন সহপাঠীদের সঙ্গে বাসায় ফিরছে। কিছুদূর আসার পর একজন ছেলে জিজ্ঞেস করল,

– তোমাদের বাসা কোথায়?
– ওই যে, ওটি। একটি বাড়ি দেখিয়ে জবাব দিল।
– ওটি তো প্রেসিডেন্টের। ছেলেটি বলল।)
– আমার আব্বা তো প্রেসিডেন্ট। জবাব এল। অর্থাৎ কেউ হাবে-ভাবে বুঝতে পারত না যে তারা প্রেসিডেন্টের ছেলে।

সমুদ্র ভালোবাসতেন জিয়া। দেশ ও জনগণের জন্য তাঁর হৃদয় ছিল বিশাল সমুদ্রেরই মতো। এই সমুদ্রের ধারা প্রায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে ভালোবাসায় সিক্ত করেছে। মৃত্যুর আগে দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন সমুদ্রভ্রমণে। সেখানে তিনি কবি আল মাহমুদের সঙ্গে আলাপের সময় বলেন, “নজরুল সমুদ্রকে বুঝতেন বলেই তাঁর জীবন উত্তাল। নির্ভীকতা ছাড়া বড় হওয়া যায় না।”

সমুদ্র ভ্রমণের সময় অনেকেই ভেবেছিল সেখানে হয়তো শুধু আনন্দ ও হৈ-হল্লা হবে। কিন্তু জিয়া সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন দেশের কঠিন বাস্তবতা নিয়ে, দেশকে কীভাবে শঙ্কামুক্ত ও উন্নত করা যায় তা নিয়ে। পরিশেষে বললেন, “শোন ছেলেমেয়েরা, আমাদের ভিটাভাঙা পলি যেখানেই জমুক তা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *