ইতিহাসের কাঠগড়ায় শেখ মুজিব – পর্ব ২/৪

পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে নির্বাচিত ন্যাপ নেতা খান ওয়ালী খান পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন ২২ মার্চ ১৯৭১। সাক্ষাৎকালে তিনি জানতে চান, তিনি (মুজিব) এখনও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন কি না। জবাবে মুজিব বলেছিলেন, ‌”খান সা’ব, আমি একজন মুসলিম লীগার” (সুত্র: মাহবুবুল আলম, বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, নয়ালোক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫)।অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করতে পারেন না। ওই বৈঠকে ওয়ালী খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের ব্যাপারে সতর্ক করতে গিয়ে বলেছিলেন, “তারা হয়ত আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে।” শেখ মুজিব হেসে বলেছিলেন “করতে চাইলে করুক, আমি তো স্যুটকেস রেডীই রেখেছি।” এর সমর্থন পাওয়া যায় সিদ্দিক সালিকের লেখা থেকে, যেখানে ২৩ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে জেনারেল খাদিম রাজার সাথে বৈঠককালে মুজিবের প্রতিনিধি জানান,”ইয়াহিয়ার প্রতি মুজিবের অনুরোধ- তাকে (মুজিবকে) যেনো গ্রেফতার করা হয়। অন্যথায় চরমপন্থীরা স্বাধীনতার ডাক দিতে পারে”।  মুজিব যে আশংকা করেছিলেন, তাহলে ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই কি চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলো?

যুদ্ধ শুরুর পরে তাজউদ্দিন আহমদ পালিয়ে ভারতে গিয়ে ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। এ সময় তাজউদ্দিন চিন্তিত ছিলেন, তার অবস্থান কি হবে এবং দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কি জবাব দিবেন। তার ভাবনা সম্পর্কে বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান জানিয়েছেন এভাবে, “তাজউদ্দিনের মনে কোন সন্দেহই ছিল না যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত তথা কোন বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। কাজেই, সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যদি সরকার গঠন করে থাকেন, তবে সেই সরকারের নেতৃস্হানীয় সদস্য হিসাবে তাজউদ্দিনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আসা এবং সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত ও সহজসাধ্য হবে বলে তাজউদ্দিন মনে করেন। অন্ততপক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবেই গণ্য হবে বলে তাঁর ধারণা জন্মায়।” অর্থাৎ তাজউদ্দিন পরিস্কার করেই জানেন, আটকের আগে মুজিব কেনো নির্দেশনা দিয়ে যান নি, তদুপরি ভারতের সাহায্য সমর্থন লাভের প্রয়োজনে স্বাধীনতার কথা এবং একটি সরকার গঠনের কথা তিনি জানাবেন। তাজউদ্দিনের এ বানানো গল্প যে ভারত সরকার বিশ্বাস করেনি, তা পরিস্কার হয় ইন্দিরা গান্ধীর ব্ক্তব্যে। মুজিবের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন রাজধানী সফরকালে ৬ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, “The cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asks for independence even now.” (Ref: Bangladesh Documents Vol-II, Page-275, Ministry of External Affairs, Government of India-1972) অর্থাৎ তার জানামতে, আটকের আগে বা ঐ সময় অবধি শেখ মুজিব নিজে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি।

pak_bharot8

শেখ মুজিবের ৪র্থ পুত্রের দাবীদার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার বইতে লিখেছিলেন, “এ সময় এক পর্যায়ে কাগমারী বেতারে ২৫শে মার্চ ১৯৭১ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়ে ….Pak Army suddenly attacked the E.P.R. base at Peelkhana and Rajarbag Police Line and killed citizens …….May Allah bless you. Joy Bangla”. (সূত্রঃ কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম, স্বাধীনতা ‘৭১, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পাতা ১৮)। কিন্তু ঐ লেখাটি যে সত্যনির্ভর ছিলো না, বরং তা ছিলো আবেগমথিত, ৩০ বছর পরে কাদের সিদ্দিকী সে কঠিন সত্যের মুখোমুখি হলেন ২০১১ সালের ২ এপ্রিল। এ দিন তিনি জানান দেন, “আমি চট্টগ্রাম থেকে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছি এবং উৎসাহিত হয়েছি। আজ যারা এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছেন তারাও শুনেছেন এবং উৎসাহিত হয়েছেন। এখন এ বিষয়টিকে তারা ভিন্নভাবে দেখছেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর নামে দিয়েছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে মনে করি না। আর স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করতে পারি না” (সূত্রঃ শীর্ষ নিউজ ২ এপ্রিল ২০১১)। তার এ বক্তব্যে আওয়ামীগের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনা উঠে। এর জবাবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আবারো লিখেন, “বঙ্গবন্ধুর হাজারো বক্তৃতা বিবৃতি আছে, তার কণ্ঠে হাজারো ঘোষণা আছে। কিন্তু ও রকম বাংলা-ইংরেজিতে কোনো কিছু আছে কি? নেই। ……জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে যে ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়েছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে শুনেছি, তাতে যদি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হয়, তারা লাভবান হয়, আমার কিছু করার নেই। আমি যা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারব না। যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারা অস্বীকার করতেই পারেন” (সুত্রঃ দৈনিক আমার দেশ, ৫ এপ্রিল ২০১১)।

pak_bharot7

ভারত সরকারের প্রকাশিত ”Bangladesh Documents” পুস্তকের ৩৫ পৃষ্ঠায় ২৭ মার্চ ১৯৭১ পিটিআই পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, Mr. Rahman বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষনাটিকে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা হিসাবে অনেক গণমাধমে দাবী করা হয়েছে। কিন্তু পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ঐ ঘোনাটিও জিয়াউর রহমানের ঘোষণাকে শেখ মুজিবের নামে চালানো হয়েছে, যেহেতু তাদের দু’জনের শেষ নাম ছিল ’রহমান’, যার ফলে সংবাদ পরিবেশকরা শেখ মুজিবের নামে প্রকাশ করেছে। যার প্রমান মেলে যুদ্ধকালে ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ Bangladesh At War পুস্তকের ৪৫ পাতায় জেনারেল সফিউল্লাহ পরিস্কার করে লিখেছেন মি. রহমানের ঐ ঘোষণাটি হলো জিয়াউর রহমানের। জিয়ার ২য় স্বাধীনতায় ছিল, “I Major Zia; provisional commander-in- chief of the Bangladesh liberatin army. hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibar Rahman, The independent of Bangladesh……………….. He farther said, “ We shall not die like cats and dogs but shall die as worthy citizens of Bangla Ma.” লক্ষণীয় পিটিআই পরিবেশেত খবরে মি. রহমানের ঘোষনার মধ্যেও আছে, “We shall not die like cats and dogs but shall die as worthy citizens of Bangla Ma.” একই কথা জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় রয়েছে। তা ছাড়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লার যুদ্ধের ঘটনা শেখ মজিব আটক হওয়ার পরের। তার পক্ষে ২৬/২৭ তারিখের ঐরূপ কোনো ঘোষণা বা যুদ্ধের কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না।জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের বিশেষ সহকারী মঈদুল হাসান বলেনঃ “আমি অন্যের কথা কী বলব, মেজর জিয়ার বেতার বক্তৃতা শুনে নিজে আমি মনে করেছিলাম যে, না, সত্যি তাহলে একটা ফরমিডেবল নাম্বার অব আর্ম ফোর্সেসের লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। ইট ক্রিয়েটেড এ ট্রিমেন্ডাস ইমপ্যাক্ট অন মি।” তিনি আরও লিখেছেন, ভারতে যাওয়ার পথে তাজউদ্দীন আহমেদ ও আমীর-উল ইসলাম রেডিওতে জিয়ার ঘোষণা শুনতে পান। হোসেন তৌফিক ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ এ জানিয়েছিলেন ভারতে যাওয়ার পথে রেডিওতে জিয়ার ঘোষণা শুনতে পান।

Pakistan_Passport

পাকিস্তানী পাসপোর্ট

স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব ফিরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী। এর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরে মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়ানওয়ালি জেলে এবং পরে লায়ালপুর এলাকার একটি এপার্টমেন্টে রাখা হয়। তাকে একজন বাঙ্গালি বাবুর্চি দেয়া হয়েছিল, বই পড়তে দেয়া হতো এবং পাঞ্জাবের গভর্নরের লাইব্রেরি তার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মোকাবেলার জন্য সরকারী খরচে কৌসুলি দেয়া হয়েছিল। ডঃ কামাল হোসেন এবং একে ব্রোহী ছিলেন তার কৌসুলি। যুদ্ধকালে মুজিবকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে গর্ত খোড়ার একটি অভিযোগ করে গেছেন, যা সম্পুর্ন মিথ্যা। বরং ভারতের সাথে যুদ্ধ চলার কারনে দেয়ালের পাশে ট্রেন্চ খোড়া হয়েছিল। সেটাকেই ভুল করেছিলেন মুজিব। কামাল হোসেন যদিও মিয়ানওয়ালি কারগারে বন্দি ছিলেন, তারপরেও মামলার কারনে প্রায়শই তাদের দেখা সাক্ষাৎ ঘটতো। ডঃ কামাল হোসেন সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দেশে ফেরার জন্য মুজিব ও কামাল হেসেন পাকিস্তানী পাসপোর্ট তৈরী করিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে (সূত্রঃ  সাপ্তাহিক, ২৮ অক্টোবর ২০১০)। ওই পাসপোর্ট নিয়েই পাকিস্তানী নাগরিক হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশে আসেন ১০ জানুয়ারী ১৯৭২। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে- স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও মুজিব পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসলেন কোন্ বিবেচনায়? বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করা অসম্ভব হলে ২১ দিনে নিদেনপক্ষে জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্ট পাওয়া অসম্ভব ছিলো না। পাকিস্তানী বিমান ভারতের আকাশ পার হতে পারবে না, এমন খবর জেনে মুজিব যেখানে জাতিসংঘের বিমানে আসার কথা চিন্তা করতে পারেন, সেখানে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ব্যতিরেকে ভিন্ন ব্যবস্থায় ঢাকা আসা বিবেচনা করাই মুজিবের মত নেতার পক্ষে সঙ্গত ছিলো। আটকের আগে যদি শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েই থাকেন, তাহলে একটি স্বাধীন দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি কি শত্রুরাষ্ট্রের পাসপোর্ট নিতে পারেন? এখানেই বড় বিস্ময়! বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানার পরে মুক্ত হয়ে তিনি প্রথমেই ঢাকায় কথা বলবেন- দলীয় সাধারন সম্পাদকের সাথে, তারপরে করণীয় ঠিক করবেন। তা না করে তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারী ঢাকায় এলেন। এসেই তিনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তখন কি তিনি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ছেড়েছিলেন? নাকি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেছিলেন? করে থাকলে, কবে? প্রশ্ন উঠে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে কি মুজিবের কাছে পাকিস্তানের পাসপোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ন ছিলো? এ প্রশ্নের জবাব মেলে এ কে ব্রোহীর কাছে, যিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে বিচারকালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শেখ মুজিবের আইনজীবি। ব্রোহী তার জীবন সায়াহ্নে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় লন্ডনের ইমপ্যাক্ট ইন্টারন্যশনাল পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে দু’টি সত্য (facts) প্রকাশ করেছেন। তা হলো – যুদ্ধ চলাকালে ১. মুজিব অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন এবং সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, কখনই পাকিস্তান ভাঙ্গার মত কোনো কাজ করেন নি; ২. পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রেডিও টিভিতে নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য দিতে ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুজিব। (সূত্র: Impact International, 25th September, 1987, Page.19).

লেখক: মোঃ শামসুল আলম
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

    ইতিহাসের কাঠগড়ায় শেখ মুজিব -৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *