একটি জাতির জন্ম

আদালতের রায় শিরোধার্য। আদালত যে রায় দেন তাই মেনে নিতে হয়। আদালতের রায় মানে তো বিচারকের হুকুম। যা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কথায় বলে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। আদালতের রায়েরও নড়চড় হয় না। তবে আপিল করার সুযোগ থাকে। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যে রায় মাননীয় আদালত দিয়েছেন সে ব্যাপারেও আপিল হয়েছে। জানি না এ আপিলে কী হবে।

স্বাধীনতার ঘোষক সম্পর্কে মাননীয় আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং কেন্দ্র থেকে দেয়া জিয়াউর রহমানের ঘোষণা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। সংবাদপত্রে রায়ের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে এ ব্যাপারে কিছু পাওয়া গেল না। বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ভোরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সে ঘোষণা সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল।

অথচ ইতিহাস বলে, ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে করাচি নিয়ে গিয়েছিল। করাচি বিমানবন্দরে পুলিশ প্রহরায় তার বসে থাকা একটি ছবিও সে সময় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। রায়ে বলা হয়নি, ‘২৬ মার্চ ভোরে’ দেয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি কি ছিল। কেমন করেই বা ২৫ মার্চের সেই ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন আর কেমন করেই বা সে ঘোষণা দেশের সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে কখনো শোনা যায়নি। স্বাধীন বাংলা বেতারে কি তা একবারও প্রচার করা হয়েছে? ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর আম্রকাননে স্বাধীন বাংলার অস্হায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও তো সে ঘোষণা পাঠ করা হয়নি।

আদালতের রায় অনুযায়ী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তাহলে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি কি বলেছিলেন? আর সেই সন্ধ্যায় আমরাই বা কি শুনেছিলাম? একটি রায়ে আমাদের সব কিছু কি মিথ্যা হয়ে গেল? মিথ্যা হয়ে গেল আমার সেই আবদুল্লাহপুরের স্মৃতি, জিঞ্জিরা থেকে আরো অনেকটা পথ এগিয়ে যে গ্রামে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আমি, আমার মতো আরো কয়েকজন এবং গ্রামের আরো মানুষেরা নিজেদের কানে শুনেছিলাম জিয়াউর রহমানের ঘোষণা। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছরে জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণার সত্যতা তো কাউকে অস্বীকার করতে শুনিনি। তবে বিতর্ক তোলা হয়েছে। বিতর্ক উঠেছে তার ঘোষণাটিই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে কি না তা নিয়ে। বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুই ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। বলা হয়েছে জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন তবে তা ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে, তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পাঠক ছিলেন মাত্র। এ সবই বলা হয়েছে রাজনীতির স্বার্থে। কিন্তু কেউ বলেননি জিয়া কোনো ঘোষণাই দেননি। রায়ে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের ‘একটি জাতির জন্ম’ লেখাটির উল্লেখ করে তার সততার প্রশংসা করা হয়েছে এবং এতে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান এই লেখায় কোথাও বলেননি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মাননীয় বিচারপতি মহোদয়রা কি লক্ষ্য করেননি জিয়াউর রহমানের এই লেখাটি শেষ হয়েছে ২৬ মার্চ রাতে তার বিদ্রোহ ঘোষণার ঘটনার মধ্য দিয়ে। লেখাটির শেষ তিনটি লাইন হচ্ছে, ‘তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। রক্ত আখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণে রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণে রাখবে, ভালবাসবে। এই দিনটিকে কোনোদিন তারা ভুলবে না। কো-ন-দি-ন না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *