রণাঙ্গনে জিয়ার বীরত্বগাথা

(1977) as founding Commandant of School of Armour & Centre in Bogra with CMLA General Ziaur Rahmanএকাত্তরের রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের বীরত্বগাথা লিখে শেষ করা যাবে না। তিনিই প্রথম ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত করেন। ২৭ মার্চ তিনিই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং ৩০ মার্চ জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। রণাঙ্গনে তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সবসময় সামনে থাকতেন এবং কমান্ডারদের সৈনিকের সামনে থাকতে পরামর্শ দিতেন। চট্টগ্রামের একটি ভয়াবহ যুদ্ধে আমরা তাকে বাংকারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি সেখানে যাননি। বলেছেন, আমি বাংকারে গেলে আমার সৈনিকরা পালিয়ে যেতে পারে। বাংকারে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের দু’দিন আগে সিলেটের এমসি কলেজের পাশ দিয়ে সিলেট শহরে ঢোকার আগে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক গোলাবর্ষণের শিকার হয়েছিল জিয়ার বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে সহকর্মীরা তাকে পিছিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সবাই মরে গেলেও সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন।
একাত্তরের রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের যুদ্ধ ও বীরত্ব সম্পর্কে এ তথ্য তুলে ধরেছেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী। রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি। যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি গ্রেফতার হয়ে একাত্তরের বন্দি শিবিরে ছিলেন। একাত্তরে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেয়ার পর সেটি কালুরঘাট বেতার থেকে শমসের মবিন চৌধুরী নিউজ বুলেটিন আকারে কয়েকবার পাঠ করেন।
রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী জানান, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভূমিকা, বিশেষ করে রণক্ষেত্রে তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। রণক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের অভিজ্ঞতা অনেক আগের। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি অসাধারণ রণনৈপুণ্য দেখিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন তখন। তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার হিসেবে ওই যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৯৭১ সালের আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহস এবং বীরত্ব দেখান। তিনিই প্রথম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। জিয়াউর রহমানের সামরিক কৌশলের জ্ঞান ছিল অসীম এবং অতুল্য।
শমসের মবিন চৌধুরী জানান, তত্কালীন মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পাকিস্তানের সামরিক একাডেমিতে একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি সেখানে সামরিক ইতিহাস পড়াতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের যুদ্ধে সেখানকার সামরিক কমান্ডাররা যেসব রণকৌশল গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোই মূলত জিয়াউর রহমান পড়াতেন। তাই কৌশলের ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল সীমাহীন। সেই জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ ঘটান তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত একটি গেরিলা যুদ্ধ। আর এ গেরিলা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ছিল জিয়াউর রহমানেরই। যুদ্ধকৌশল হিসেবে তিনি এই গেরিলা যুদ্ধকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি যখন বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করলেন, তখন তিনি দেখলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৩শ’। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। মাত্র সাতজন অফিসার এবং ৩শ’ সৈন্য নিয়ে ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এই স্বল্পসংখ্যক সৈন্য এবং অপ্রতুল অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি প্রথমে তার বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এই বিদ্রোহ ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ, যা জিয়াউর রহমানের মতো সমরনায়কের পক্ষেই সম্ভব ছিল। পাকবাহিনীর হাতে ছিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। এমনকি চট্টগ্রামে একটি ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টও ছিল। এই বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ করাটা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহরের কাছে। তিনি আমাদের চট্টগ্রাম শহর থেকে কালুরঘাট ব্রিজ হয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর নিয়ে গেলেন। তিনি যুদ্ধের রণকৌশল হিসেবে আমাদের তখন জানান, আমরা গেরিলা যুদ্ধের মতো একটি যুদ্ধ করব। সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাব। আবার নিরাপদ স্থানে চলে যাব। এভাবে পাকবাহিনীকে আমরা হয়রানি করব। তাদের কোনোভাবেই আমরা স্থির থাকতে দেব না।
এরই মধ্যে মার্চের ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখ অন্যান্য অঞ্চলেও বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাঙালি সিনিয়র সেনা অফিসারদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে মেজর জিয়াউর রহমান ছাড়াও মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর (অব.) সি আর দত্ত, আবু ওসমানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকেই মুক্তিযুদ্ধের একটি সাংগঠনিক রূপ দেয়া হয়। ওইদিনই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর করে দেয়া হয়। তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত ৩ ও ৪ এপ্রিলের বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয় বাঙালি সেনারা সশস্ত্র যুদ্ধ করবে, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাদের খুঁজে এনে একটি সরকার গঠন করা হবে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠন করা হয় জেড ফোর্স। জেড ফোর্সের দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এছাড়া মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স এবং মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্স গঠন করা হয়।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়া সম্পর্কে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, আমি ছিলাম অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন লেফটেন্যান্ট। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমি যুদ্ধ করেছি। আমার নেতৃত্বে ছোট এক কম্পানি সৈন্য ছিল। আমরা বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সৈন্যের বিরুদ্ধে কমবেশি গেরিলা টাইপ আক্রমণ করতে থাকি। মুখোমুখি যুদ্ধ করা—আমাদের তেমনটি সম্ভব ছিল না। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদও ছিল অত্যন্ত কম। পরে ভারত থেকে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসতে থাকে, যেগুলো আমরা তখন ব্যবহার করেছি। এসময় জিয়াউর রহমানের নির্দেশে যুদ্ধের কৌশলের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। জিয়াউর রহমান আমাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, কালুরঘাট আসার পথে চকবাজারের মোড়ের রাস্তাটি যদি বন্ধ করে দিতে পার, তাহলে পাকিস্তান আর্মি শহর থেকে আর বাইরে আসতে পারবে না। তারা শহরের ভেতরেই আটকা পড়ে থাকবে। তিনি আমাদের শিখিয়ে দিতেন কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে, কোথায় মেশিনগান বসাতে হবে এবং কীভাবে পজিশন নিতে হবে। মাইক্রো লেভেলে যুদ্ধের এই কৌশলের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা ছিল অসাধারণ। যুদ্ধক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সবসময় সামনে থাকতেন। তিনি আমাদের প্রায়ই বলতেন, এটি একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ। ‘You have to lead by an example, not by the order.’ যেহেতু এটি একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ, তাই তোমাকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এজন্য তিনি সবসময় সামনে থাকতেন এবং আমাদের বলতেন, তোমাদের অবশ্যই কমান্ডার হিসেবে সামনেই থাকতে হবে, যাতে তোমার সৈনিকরা চোখ ফিরিয়ে দেখতে পারে তুমি তার পাশেই আছ। এটাই একজন কমান্ডারের মূল বৈশিষ্ট্য।
আরেকটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। ১১ এপ্রিল আমি আহত হয়ে পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়ার আগের ঘটনা এটি। দিনটি ছিল সম্ভবত ৭ এপ্রিল। কালুরঘাট ব্রিজের পাশে আমরা অবস্থান নিই। পাকিস্তান আর্মি খবর পেয়ে যায় মেজর জিয়াউর রহমান এখানে আছেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন তাদের সবচেয়ে বড় টার্গেট। এরপর পাকিস্তান আর্মি আমাদের ওই স্থানে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমাদের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে অবিরাম গুলিবর্ষণ চলছে। একই সঙ্গে শেলিংও হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটি ভয়াবহ অবস্থা। আমি জিয়াউর রহমানকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার, আপনি কি কোনো বাংকারে যাবেন কিনা? তিনি তখন বললেন : ‘If a bullet has my name written on it, it will find me whenever I go. I will not go inside any bunker. That will discourage my troops. We must lead by example, not just by command.’
সুতরাং বাংকারে গেলে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এর কোনো নিশ্চিয়তা নেই। আর আমি যদি বাংকারে চলে যাই, তাহলে আমার সৈনিকেরা পালিয়ে যেতে পারে। কারণ পাকিস্তান বাহিনী যেভাবে গুলিবর্ষণ করছে, তাতে একজন সাধারণ সৈনিকের ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে বড় কথা তোমার মৃত্যু থাকলে তা কেউ রোধ করতে পারবে না। এসবই ছিল রণক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের বীরত্বের দৃষ্টান্ত। সত্যি কথা বলতে কি, জিয়াউর রহমানের যে বীরত্ব ও সাহস ছিল তা অকল্পনীয়। খুব কম লোকের মাঝেই এমনটি খুঁজে পাওয়া যায়।
শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, আর একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে গিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানীদের জন্য একটি সহজ টার্গেট ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে জিয়াউর রহমানকে একাধিকবার কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যেতে হয়েছিল। ২৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং ৩০ মার্চ তিনি জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। তিনি নিজেকে ভারপ্রাপ্ত সরকার প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেদিন। এটা ছিল তার রাজনৈতিক সাহসের একটি বড় পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি সামরিক যুদ্ধ ছিল না। এর সঙ্গে রাজনীতির একটি বিরাট সম্পৃক্ততা ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আহ্বান জানালেন। বিশ্ববাসীর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিলেন যে, বাংলাদেশের সব মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করছে। ১৯৬৫ সালে তিনি শুধু সামরিক দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। আর ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে সামরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে মূল্যায়ন করতে হবে এই সার্বিকভাবে। অনেকেই চেষ্টা করেন জিয়াউর রহমানকে শুধু একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মূল্যায়ন করতে। কিন্তু সেক্টর কমান্ডার তো অনেকেই ছিলেন। মোট ১৬ জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। নেতা তো হয়েছেন মাত্র একজন। যে নেতার নামে আজ একটি আদর্শ তৈরি হয়ে গেছে বাংলাদেশে। হাতে বন্দুক ছিল বলেই এটা হয়নি। তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহস সর্বোপরি তার ব্যক্তিত্ব তাকে ওই পর্যায়ে নিয়ে যায়।
১১ এপ্রিল আমি আহত হয়ে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ার পরে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের পর তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। তখন আমার সঙ্গে আবার দেখা হয়। তবে আমি বন্দি থাকার সময় আমার পাশের রুমে পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা প্রায়ই জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করত। তাদের ওই কথাবার্তা আমি শুনতে পেতাম। তাদের মূল টার্গেট ছিল জিয়াউর রহমান। তারা বলাবলি করত, জিয়াউর রহমানকে যদি আটকানো যায় তাহলেই বাঙালিদের মনোবল ভেঙে যাবে অনেকটা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান রণক্ষেত্রে যে বীরত্ব দেখান তা আমার চেয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন মীর শওকতসহ অন্যরা। পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে জিয়াউর রহমানের বীরত্বের অনেক কাহিনী আমি শুনেছি। কর্নেল জিয়াউদ্দিন আমাকে একটি ঘটনার কথা বলেছেন। স্বাধীনতা লাভ অর্থাত্ ১৬ ডিসেম্বরের মাত্র দু’তিনদিন আগে জিয়াউর রহমান সিলেটের এমসি কলেজের পাশ দিয়ে সিলেট শহরে ঢোকার জন্য রওনা হন। পাশেই পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল। জিয়াউর রহমান এবং তার সহযোগীদের গাড়ির ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে অন্য অফিসাররা জিয়াউর রহমানকে পিছিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাত্ক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন আমরা সবাই মরে গেলেও সামনের দিকে এগিয়ে যাব। জিয়াউর রহমানের এই বীরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণেই সেদিন সিলেট শহরের পতন ঘটে। জিয়াউর রহমান যে কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং আমাদের সবসময় বলতেন, আমার জীবন এবং একজন সাধারণ সৈনিকের জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একজন সৈনিক যদি তার জীবন বিসর্জন দিতে পারে, তাহলে কমান্ডার হিসেবে আমি কেন পারব না? জিয়াউর রহমানের ত্যাগের আর একটি উদাহরণ আমি দিতে পারি। ২৫ মার্চ রাতে তিনি বিদ্রোহ করার পর আমাদেরসহ ৩শ’ সৈনিক নিয়ে কালুরঘাটে যাওয়ার পথে নিজের বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বাসায় তার স্ত্রী ও দু’ছেলে ছিলেন। আমি জিয়াউর রহমানকে বললাম, স্যার বাসায় তো ভাবী আছেন, এক মিনিটের জন্য হলেও তো তাকে দেখে যেতে পারেন। তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে উত্তর দিলেন, তাহলে বাকি এই এই ৩শ’ পরিবারের কি হবে? সামনের দিকে এগিয়ে চল। তাদের আল্লাহ দেখবেন।
এসবকিছু মিলিয়ে রণক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই। তিনি বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পুরো দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেন। অন্যদিকে দীর্ঘ নয় মাস রণাঙ্গনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। সব মিলিয়ে বিবেচনা করলে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিশ্চিতভাবে সবার উপরে।

সাক্ষাত্কার : বশীর আহমেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *