শহীদ জিয়াকে স্মরণের সার্থকতা

01006বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের এক ক্ষণজন্মা সত্তার স্মরণে আজ দেশবাসী শোকার্ত। তিনি শহীদ জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের প্রথম জননির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তার সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব, দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা, জনসাধারণকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করার পদক্ষেপ এবং নিজের প্রশ্নাতীত সততা তাকে একযোগে তার সমসাময়িক কালের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব সত্তায় জাগিয়ে তুলে পথ চলার চেতনা নির্মাণে শহীদ জিয়া বলেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা। প্লুরালিস্টিক বা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি অখণ্ড নিবেদনের প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধ মতের প্রতি তিনি ছিলেন সহনশীল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নামক আজকের লাগসই চলতি শব্দটি ব্যবহার না করে বলব, বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্যে, এর কর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসেরও প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি।
শাহাদতবার্ষিকীতে এই যে কথাগুলো বললাম, এরই একত্র সন্নিবেশের মধ্য দিয়ে জীবনকালে জিয়াউর রহমান একজন সামরিক অধিকর্তার সত্তা থেকে নিজের উত্তরণ ঘটান একজন রাষ্ট্রনেতায়। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র রাজনীতির অঙ্গনে তার পদচারণার আগের সময়টি ছিল সর্ব অর্থে অন্ধকার। তাকে নিজের সময়টিকে পূর্বসময় থেকে পৃথক করতে হয়েছে। এই কাজটি তিনি করেছেন দেশবাসীর দৃষ্টির সম্মুখে থেকে। দেশবাসী সময়ের এবং ব্যক্তির, গত জমানার এবং নতুন নেতৃত্বের পরিচালনায় রাষ্ট্রের আলাদা বৈশিষ্ট্য সহজে অনুধাবন করতে পেরেছে। সংক্ষেপে বলি : ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুল অঙ্গনের বিগত সময় এবং নতুন সময়ের পার্থক্য, রাজনীতি-নিরপেক্ষতার চারিত্র্য নির্মাণ, কৃষিকে গতিশীলতা-উত্পাদনশীলতায় জাগিয়ে তোলা এবং এতে ব্যাংক ঋণ সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে কৃষি পুঁজির বিকাশসাধন, শিল্প খাতকে উদ্যমশীল করে একে বহুধা বিকশিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ, গার্মেন্ট নামে সম্পূর্ণ নতুন খাতের সংযোজন ঘটিয়ে শিল্পপুঁজির বিকাশে চেষ্টা, দেশের কৃষি ও পল্লী খাতের বিপুল অলস-অদক্ষ জনশ্রেণীর জন্য বিদেশে শ্রমবাজারের সন্ধান দান, সমুদ্র উপকূলের জমিতে লোনাপানির চিংড়ি চাষ—এই সবকিছুতেই শহীদ জিয়া পথ দেখান একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শুধু নয়, একজন অগ্রণী দেশকর্মী হিসেবেও। স্বাধীন দেশ, তার বর্ধিত লোকসংখ্যা, বর্ধিত চাহিদা ইত্যাদি হিসেবে নিয়েই জিয়া নতুন নতুন পথ উন্মোচনে সচেষ্ট হন। পাশ্চাত্যের আরোপিত কলঙ্ক অভিধা ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে দেশকে স্বনির্ভরতায় বিকশিত করতে হবে—এই চেতনাও তিনি ছড়িয়ে দেন দেশবাসীর মাঝে। চাকরিক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য সুযোগের দুয়ার উন্মুক্ত করা, সংস্কার ভেঙে ফেলতে পুলিশে-আনসারে মেয়েদের চাকরি দেয়া—এসব কাজ শুরু হয় শহীদ জিয়ার সময়।
তারপর পাঁচ, সাড়ে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ঘটনার আবর্তে আবার এলেন তিনি এবং এসে তিনি শুরু করেন এক আধুনিক রাষ্ট্রনির্মাণের কাজ। একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবে নিজের ব্যক্তিচিন্তা ও কর্মের প্রভাব সঞ্চারে তিনি গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। বর্জনবাদী, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসিকতাসম্পন্ন স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তার ছিল না। বরং তাঁর রাজনৈতিক কর্ম বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রহণবাদী, একোমোডেটিভ মানসিকতা ছিল তার। এর ফলে অতি বাম, অতি ডান গোষ্ঠীর সবাই তার দলে এসে ঠাঁই পেয়েছেন এবং নতুন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তার সেই কাজের প্রভাব আজও সমাজে দৃশ্যমান। তার জীবনকালে যারা অনেকে তার বিরুদ্ধবাদী ছিলেন, পরে তারা বিএনপিতে এসেছেন এবং শহীদ জিয়াকে তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী-বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে একথা সত্য। এখানেই শহীদ জিয়ার প্রভাবের চিত্রটা উপলব্ধি করা যায়।
শহীদ জিয়াকে স্মরণের সার্থকতা কোথায়, তা ঠিক করতে হবে আমাদের। আমরা যারা এখন কথা বলছি, শুনছি, সবাইকে এই সার্থকতার দিকটা নিয়ে ভাবতে হবে। আমি বলব, জিয়ার জীবন-চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা যদি আমাদের মধ্যে ধারণ এবং বিকশিত করতে পারি, তবেই পাব স্মরণের সার্থকতা। বিএনপি নেতা-কর্মীদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলব, আসুন, আমরা সেই পথ অনুসরণ করি।
আজ বর্তমান রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে শহীদ জিয়ার চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র, সহনশীলতা, জনজীবনকে আত্মবিশ্বাসে মণ্ডিত করা—এর সবকিছু ২০০৭ এবং ২০০৮-এর ছদ্ম সামরিক শাসন ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, যার প্রকাশ্য মদতে ছিল আজকের এই মহাজোট সরকার। হুদা-ছহুলদের নির্বাচন কমিশন ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ঘোষণা করেছে একটি একদলীয় পার্লামেন্ট। যতই বিশ্বমন্দার ঢাক পেটানো হোক না কেন, দেশে বিনিয়োগ প্রবাহ বন্ধ। ফসলের দাম নেই। কৃষক দিশেহারা। ভোক্তার নেই ক্রয়ক্ষমতা। মূল্যবৃদ্ধির দাপটে মধ্যবিত্ত অস্থির-অসহায়। ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত। সেনাবাহিনীর অর্ধশতাধিক অফিসার খুন করে তার মনোবল ভেঙে দেয়া হয়েছে, বিডিআর অস্তিত্বহীন। স্বাধীন রাষ্ট্রের কাঠামো প্রায় ধ্বংস। তাই নাগরিক হিসেবে নিজের মধ্যে এক ভীতি অনুভব করি। এ সময় আমরা সবাই একযোগে বলি না কেন, শহীদ জিয়া জিন্দাবাদ; সারা বাংলার ধানের শীষে জিয়া তুমি আছ মিশে।
শহীদ জিয়ার চেতনা, শহীদ জিয়ার অবস্থান আমাদের সবাইকে এমন আদ্যশক্তিতে জাগিয়ে তুলুক যে, আমরা বলতে পারি, আমরা সবাই আধুনিক, অগ্রসর, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নাগরিক। মনের দেউড়িতে বসে শহীদ জিয়াকে বারবার স্মরণ করার, পিছু হটে যাওয়া সেই সময়ের চেহারা দেখার লোভ ভেতরবাগে সব সময় বয়ে চলে। সময়ের ওই আদলটাকে মুঠো ভরে ধরতে কী শান্তি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *