২৫ শে মার্চ ৭১

২৫ মার্চ শেখ মুজিব আদৌ কি কোথাও কোন বার্তা পাঠিয়েছিলেন কিনা এ প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়না। ৭১ সালের ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর রাত। বাংলাদেশের জনগন স্বাধীনতার জন্য রণপ্রস্তুত থাকলেও এই রাতেই সে সময়কার প্রধান রাজনৈতিক নেতা নিজের ধানমন্ডির বাসায় থেকে স্বেচ্ছাসমর্পন করেন পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে। পাকিস্তানীদের হাতে স্বেচ্ছাসমর্পনের আগের কয়েকঘন্টায় কি হয়েছিলো শেখ মুজিবের বাসভবনে। জেনে নেয়া যাক।

২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর শেখ মুজিবের বাসভবনে পাকিস্তানী সাংবাদিক তারিক আলীর পিতা মাজহার আলী এবং রেহমান সোবহান শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন এবং তাকে জানান মিলিটারী ক্রাকডাউন আসন্ন।  [ সূত্র: বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এবং একজন প্রতক্ষ্যদর্শীর ভাষ্য , রেহমান সোবহান , ভোরের কাগজ প্রকাশনী , ১৯৯৪ ]

শেখ মুজিব এরপর ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১জন সংবাদবাহক স্থানীয় এবং বিদেশী সাংবাদিকদের মাঝে ১টি প্রেসনোট বিলি করেন যেটিতে উল্লেখ করা হয়,  “প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা চুড়ান্ত হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের মতানৈক্য হয়েছে এবং আমি  (শেখ মুজিব) আশা করি প্রেসিডেন্ট তা ঘোষনা করবেন”। এ বিষয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন: “আমার দুঃখ হয়, এই নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই”। [ সূত্র: রেপ অব বাংলাদেশ , অ্যান্থনি মাসকারেনহাস , অনুবাদ মযহারুল ইসলাম , ১৯৭৩ , পৃষ্ঠা:১১৩ ]

২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর ভেতর ৪৫ মিনিটের ১টি মিটিং হয়। শেখ মুজিব পূর্বঘোষনা অনুযায়ী ২৫শে মার্চে ইয়াহিয়ার ভাষনের জন্য অপেক্ষা করেন। সন্ধ্যা ৬টায় ইয়াহিয়া করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার এই ঢাকা ত্যাগের প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলেন ২ জন বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা। ১. ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এটি প্রতক্ষ্য করেন লে. কর্নেল এ. আর চৌধুরী ২.বিমানবন্দরে এটি প্রত্যক্ষ করেন এয়ারফোর্সে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খোন্দকার। শেখ মুজিব তখনো ১ টি ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলেন এবং ডক্টর কামাল হোসেন কে বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন কোন ফোন এসেছে কিনা। প্রতিবারই ডক্টর কামালের উত্তর ছিলো না সূচক। ফোনটি আসার কথা ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট জেনারেল পীরজাদার কাছ থেকে।কারণ ইয়াহিয়া বলেছিলো তার ভাষন প্রচারের আগে পীরজাদার সাথে শেখ মুজিবের ১টি ছোট বৈঠক হবে। সেই ফোনকল আর আসেনি কোনদিন। শেখ মুজিবও বুঝতে পারেন সব আশা শেষ। ইয়াহিয়া ধোঁকা দিয়েছে।[ সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব , জীবন ও রাজনীতি , ১ম খন্ড , সম্পাদক মোনায়েম সরকার , বাংলা একাডেমী ২০০৮ , পৃষ্ঠা:৪৪৭ ]

রাত ৮টার দিকে এরকম একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী , তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে চলে যান।  শেখ ফজলুল হক মনি ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায়ই টুঙ্গিপাড়া চলে যায় এবং শেখ কামাল রাত ৯টায় ধানমন্ডী ৩২নং ছেড়ে যান। [ সূত্র : শেখ মুজিব , এস.এ. করিম, ইউপিএল, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৯৫ ]

রাত ৯টার দিকে ডক্টর কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ৩২নং বাসা থেকে বিদায় নেন। রাত ৯ টা ১০ মিনিটের দিকে ঠিক এই সময়েই প্রথমবারের মত গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন জানান রেহমান সোবহান। [ সূত্র : প্রাগুক্ত ]

রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইস্ট পাকিস্তান শিপিং  কর্পোরেশনের ম্যানেজেং ডিরেক্টর ক্যাপ্টেন রহমান এবং ২ জন এক্স নেভাল অফিসার কমান্ডার ফারুক এবং লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান দেখা করতে আসেন শেখ মুজিবের সাথে। এ সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এর কাছ থেকে ১টি ফোন আসে শেখ মুজিবের কাছে। “ইপিআরকে ডিসআর্মড করা হয়েছে” শেখ মুজিব কে এতটুকু বলতে না বলতে লাইন কেটে যায়। [ সূত্র : শেখ মুজিবের বাসভবনে সে সময় অবস্থানরত পারিবারিক কর্মচারী মমিনুল হক খোকা , প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা – ৪৪৭-৪৮ ]

রাত ১১টায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রধান আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে আত্মগোপন করার অনুরোধ জানান। শেখ মুজিব সরাসরি তাকে জানিয়ে দেন, তিনি বাসা ছেড়ে যাবেননা। সূত্র : আর্চার ব্লাড, দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৯৮]

রাত সোয়া ১১টার দিকে সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ তারা সবাই শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাসা ত্যাগ করেন। শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে এটাই ছিলো শেখ মুজিবের সাথে ওই রাতে তাদের শেষ বৈঠক।

ডক্টর ওয়াজেদ মিয়ার বক্তব্য অনুসারে জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা জাকারিয়া চৌধুরীর ভাই ঝন্টু ধানমন্ডীতে শেখ মুজিবের বাসায় আসেন রাত সাড়ে ১১টার দিকে। শেখ মুজিবকে অপারেশন সার্চলাইট এবং নির্বিচার গোলাগুলির খবর জানান ঝন্টু। ঝন্টুর মাধ্যমে পরিস্থিতি অবগত হয়ে শেখ মুজিব তার কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং জেলীকে ১টি ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেন আত্মগোপন করার জন্য। শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের আত্মগোপনের জন্য আগেই ঐ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়া হয়েছিলো।  ওয়াজেদ মিয়া নিজেও রাত সাড়ে ১১টার পর ধানমন্ডী ৩২ নম্বর ত্যাগ করেন। [ সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ২০০০, পৃ ৮৪ ]  “২৫ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেখ মুজিবের বাসায় ছিলো মানুষের ঢল। কিন্তু ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রকাশ হয়ে পড়ায় এবং সেনাবাহিনীর মতিগতি দেখে সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার সর্বত্র বাড়তে থাকে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বিভিন্নস্থানে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করেন।” [ সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব , জীবন ও রাজনীতি , ১ম খন্ড , সম্পাদক মোনায়েম সরকার , বাংলা একাডেমী ২০০৮ , পৃষ্ঠা:৪৪৭ ]

এই ঘটনাপঞ্জীতে প্রমানিত হয় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি এবং দেয়ার কোন আগ্রহও ছিলোনা। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে ওইদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের বাসায় যারা এসেছিলেন তাদের কারো কাছেও দিতে পারতেন। শেখ মুজিব সেটি করেননি।   আওয়ামী লীগ দাবী করে শেখ মুজিব নাকি ২৫ মার্চ স্বাধীনতার একটি ঘোষণা চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন। সিলেট ঢাকা কিংবা রাজশাহীতে না পাঠিয়ে ঘোষনাটি চট্টগ্রামেই পাঠাতে হবে কেন? চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর সেই কৃতিত্বে ভাগ বসানোর জন্যই কি এই মিথ্যা তথ্যের অবতারনা? শেখ মুজিব চট্টগ্রামে ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে স্বাধীনতার বার্তা পাঠালে পরদিন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের পত্রিকায় এই সংক্রান্ত কোন খবর প্রকাশ হয়নি কেন? শেখ মুজিব ২৫শে মার্চ স্বাধীনতার বার্তা পাঠালে ২৭ শে মার্চ ঢাকায় হরতাল ডাকলেন কোন যুক্তিতে? বাঙালিকে ঘরে বন্দী রাখার এই ফন্দি কেন? কাদের স্বার্থে ? ২৭ মার্চ শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ববাংলায় হরতাল ডেকেছিলেন ওই দিন সেই খবর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত পিপলস ভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অথচ শেখ মুজিবের কথিত স্বাধীনতার ঘোষনা প্রকাশিত হয়নি কেন? বরং দেখা যায় শেখ মুজিব কোনরকম স্বাধীনতার ঘোষণার বিপক্ষে ছিলেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় সামরিক শাসক টিক্কা খানের গণসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার লিখিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ পুস্তকে দাবী করেছেন, “আমাকে গ্রেফতার কারুন। অন্যথায় চরমপন্থীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে” ২৩ শে মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনাকালে মুজিব ইয়াহিয়াকে এ অনুরোধ করেন। পশ্চিম বাংলার সাংবাদিক জ্যোতি সেন গুপ্ত লিখেছেন, ২৪ তারিখে গোয়েন্দা সূত্র পাক বাহিনীর আক্রমনের আগাম সংবাদ জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগকে। কর্নেল ওসমানী ওই দিনই মুজিবের সাথে দেখা করে তাকে অবহিত করেন। শেষ রাত পর্যন্ত নেতারা করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, তারা আত্মগোপন করবেন এবং পালিয়ে ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাজউদ্দিন এসে দেখেন মুজিব তার বিছানাপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে আছেন। মুজিব তাকে বললেন, তিনি থেকে যাবেন- গ্রেপ্তার বরণ করবেন (সূত্রঃ মাসুদুল হক, দৈনিক ইনকিলাব ২৬ মার্চ ২০০৫)।

শেখ মুজিব ২৭ মার্চ হরতাল ডেকে ছিলেন যা পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। তখনকার চট্রগ্রাম পিপলস ভিউ পত্রিকায় ঐদিনের সংখ্যা দেখলেই বুঝা যায়। তৎকালিন আওয়ামীলীগের মুখপত্র হিসেবে খ্যাত দৈনিক ইত্তেফাকের ১৯৭১ সালের ২৬মার্চের সংখ্যাটি পাকিস্তানী শাসকদের বাঁধার কারনে ছাপা হয়েও গ্রাহকের কাছে পৌছানো সম্ভব হয়নি সে সংখ্যাটিতে প্রথম পাতার লিড নিউজ ছিল ‘এ গণহত্যা বন্ধ কর, ২৭ শে মার্চ সমগ্র বাংলাদেশে সর্বাত্মক ধর্মঘট‘ ।

pic6   peopleview

 

বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সাক্ষাতকারেও ২৫ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনার প্রস্তুতি কিংবা উদ্যোগেরও কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছাসমর্পনের আগ পর্যন্ত বেগম ফজিলাতুন্নেসা শেখ মুজিবের সঙ্গেই ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বেগম মুজিব এক সাক্ষাৎকারে সে দিনের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেন, “…রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে তারা (পাক সেনারা) গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপরে এলো।…তারপর মাথাটা নিচু রেখে নেমে গেলেন তিনি নিচের তলায়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আবার উঠে এলেন উপরে। মেঝো ছেলে জামাল এগিয়ে দিল তার হাতঘড়ি ও মানিব্যাগ। পাইপ আর তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সাথে” (দৈনিক বাংলা, ২৬ মার্চ, ১৯৭২)। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের কোথাও বেগম মুজিব একটিবারও বলেননি যে, যাওয়ার আগে কোনো এক ফাঁকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকি আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ যুদ্ধ চলাকালে বা পরবর্তীকালে কখনই জানতেন না যে শেখ মুজিব নিজে কখনো বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *